হেমলকের নিমন্ত্রণ
-এর নির্বাচিত অংশ
#
'আজ প্লেটোর জীবনের বিশেষ দিন। তরুণ প্লেটো আজ সক্রেটিসের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সে ছোটবেলা থেকেই সক্রেটিসের নাম শুনেছে। সক্রেটিস ভীষণ জ্ঞানী। মানুষ হিসেবেও খুবই অসাধারণ। প্লেটোর মামা ক্রিটিয়াস উঠতে বসতে সক্রেটিসের নাম করে। তিনি নাকি জীবন বদলে দেন। এক নিমিষে চক্ষু খুলে দেন। মজায় মজায় এমন কথা বলেন যে মধুর মতো লাগে। সেই কথায় যুক্তি আর জ্ঞান একেবারে ঝরে ঝরে পড়ে।
কিন্তু সক্রেটিসের ব্যাপারে প্লেটোর একটা খটকা আছে। সেটি হলো সক্রেটিস নাকি নাটক পছন্দ করেন না। তিনি শুধু ইউরিপিডিসের নাটক ছাড়া থিয়েটারে যান না। প্লেটো একজন লেখক। সে কবিতা, নাটক লেখে। সক্রেটিস নাটক পছন্দ করেন না শুনে প্লেটোর খারাপ লাগে। শুধু এ কারণেই সে সক্রেটিসের সামনে যায় নি। শুধু দূর থেকে আগোরাতে দেখেছে।
মামা ক্রিটিয়াস প্লেটোকে সিমনের দোকানে নিয়ে যাচ্ছে। মামা বলেছে, সক্রেটিস তার শিক্ষক হবেন। সেজন্য প্লেটোর ভয় ভয় লাগছে। অজানা একটা আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
তাকে দেখেই সক্রেটিস বললেন, এই ছেলের কপাল এতো চওড়া কেন? এ তো মাথা দিয়েই জগত কিনে ফেলবে।
প্লেটো চমকে উঠলো। মনে হলো এমন মধুর স্বর সে জীবনে আর শোনে নি।'
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
লাজুক সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে সক্রেটিস। তার মনে হচ্ছে - সাগরের লজ্জারাঙা পানিতে সে ভাসছে। স্বপ্ন ধুয়ে ভাসছে। আবার মনে হচ্ছে – সে উড়ছে। জীবন ভিজিয়ে উড়ছে। সাথে উড়ছে সাগরের সাদা পাখি সিগাল। এজিয়ান সাগরের শঙ্খবুক-কমলাচঞ্চু সিগাল। পাখিগুলো দেখলেই ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ধরা দেয় না। সুখের মতো বদমাশ। সাগর তীরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাহাড়ি দ্বীপ। দুঃখের মতো বেহায়া। সরাতে চাইলেও নড়ে না।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
"ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে। বড় প্রেম বিরহের জন্য উপযোগী, সংসারের জন্য নয়। সংসার হলো দুটি মানুষের প্রতিদিনের ঝগড়া-ঝাটি, রাগ-ক্রোধ, অভিমান মিশানো একঘেয়ে অম্ল-মধুর জিনিস। তার জন্য দরকার সাধারণ, একঘেয়ে ছোট্ট প্রেম। বড় প্রেমে এগুলো খাপ খায় না। বড় প্রেম হলো হঠাৎ উচ্ছ্বাস, যা দুজনকে ভাসিয়ে নেয়, আশেপাশের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেম দিয়ে ভালো সাহিত্য হয়, কিন্তু ভালো সংসার হয় না।
এই প্রেম দুটি জীবনকে পুড়িয়ে দেয়, প্রত্যাশার আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সংসার। হেলেন আর প্যারিসের প্রেমে পুড়ে যায় ট্রয় নগর। বড় প্রেম কোন কিছুকে ধরে রাখে না, ধরে রাখে ছোট প্রেম। তাই অনেক আশা নিয়ে শুরু হওয়া বড় বড় প্রেমের সংসার সুখী হয় না, সুখী হয় ছোট প্রেমের সংসার।
ছোট প্রেম নিজে ছোট বলে অন্যায় রাগ-ক্রোধকে জায়গা দিতে পারে, আর জায়গা দিতে দিতে ছোট প্রেমের ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে,
সে সেক্রিফাইস করতে শিখে যায়। আর বড় প্রেম নিজে বড় বলে একটি ছোট্ট অভিমানকেও জায়গা দিতে পারে না,
ছাড় না দিতে দিতে বড় প্রেমের ব্যক্তিত্ব ছোট হয়ে যায়, সেক্রিফাইস কি জিনিস সেটাই ভুলে যায়। তাই ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে।"
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
জেলখানার ছোট্ট ঘরে মাত্র রাত নেমেছে। এক কোনে জ্বলছে জলপাই তেলের প্রদীপ। নিভু নিভু আলো। সেই ডুবন্ত আলোয় একজোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের জীবনের শেষ হিসাব নিকাশ করছেন। দুজনেই জানেন এ রাতই তাদের একসাথে কাটানো শেষ রাত। তারা নিঃশব্দে নিভু নিভু প্রদীপের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে।
তারা জানেন দিন কেটে আবার রাত হবে। সেই রাতেও এমন করেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকবে। শুধু দুজনে পাশাপাশি বসে আর সেই ডাক শুনবেন না। বৃদ্ধ আগামীকাল পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। আগামীকালই সক্রেটিসকে হেমলক খেতে হবে। আজ রাত সক্রেটিসের জীবনের শেষ রাত। শেষ রাতটি জেনথিপি সক্রেটিসের সাথে কাটাচ্ছেন। জেলখানায় আছেন জেনথিপি। বন্ধু ক্রিতো সব ব্যবস্থা করেছেন। জেনথিপি কোলের ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটির বয়স তিন বছর। মেঝেতে একটি মাদুরের উপর ঘুমাচ্ছে।
সক্রেটিস আর জেনথিপি নিঃশব্দে বসে আছেন। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে।
সক্রেটিস বললেন, বউ, সারা জীবন তুমি চিৎকার করেছ। তুমি চুপ থাকলে আমার অসহ্য লাগে। চুপ থেকো না। কিছু বলো।
জেনথিপি কিছু বললেন না। কাঁদতে লাগলেন।
সক্রেটিস তাকে থামালেন না। এ মেয়েটি সারা জীবন কেঁদেছে আর সেই কান্নায় সক্রেটিস শুধু বিরক্তই হয়েছেন।
কিন্তু আজ বিরক্ত হচ্ছেন না।
এ কান্নাকে তার খুবই আপন লাগছে, ভীষণ মধুর লাগছে। মনে হচ্ছে শুধু এই কান্নাটা দেখার জন্যই বেঁচে থাকা যায়।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
আসপাশিয়া বুঝলো, আর বেশি সময় নেই। সে পেরিক্লিসের মাথাটা কোলে নিয়ে বসলো। চারপাশে অনেক মানুষ। সবাই কাঁদছে। এথেন্সের এক নম্বর নাগরিক চলে যাচ্ছেন। তার স্বপ্নের এথেন্স ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন। পৃথিবীর নিকষ কালো অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছেন স্বপ্ন পুরুষ পেরিক্লিস।
আসপাশিয়ার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি পড়লো পেরিক্লিসের কপালে।
পেরিক্লিস আসপাশিয়ার হাতটা চেপে ধরলেন। তার চোখ পার্থেননের দিকে। চোখের জ্যোতি স্পষ্ট। হঠাৎ বলে উঠলেন, আসপাশিয়া, হোমারের সেই লাইনগুলো একবার বলবে! মরণ নিয়ে লেখা কথাগুলো-
আসপাশিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ
মরণ, বল না রে, কতো রকম তোর রূপ
সামনে-পিছনে ডানে বায়ে, যে দিক পানে চাই
আসছে মরণ, চোরা গলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই।’
পেরিক্লিসও তার সাথে বলছেন, ‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ...
আসছে মরণ, চোরাগলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই’।
পেরিক্লিস চোখ বুজলো।
দূরের আলো-ছায়ায় একটি পাখি কাঁদছে। ঝরঝর বৃষ্টি নেমেছে। মহাকালের করুণতম সুরে সন্ধ্যার বাতাস বলছে, আসছে মরণ, চোরাগলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই ...।
এথেন্সের এক নম্বর নাগরিককে কেড়ে নিলো ভয়ংকর প্লেগ। নিভে গেলো এথেন্সের স্বপ্ন। গণতন্ত্র হারালো তার প্রধান মানুষ।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
আজ সন্ধ্যায় এথেন্সে আবার ‘মেঘ’ নাটকটি অভিনীত হলো। ... প্লেটো নাটকটি দেখলো। নাটকে দেখানো হচ্ছে,
সক্রেটিস তার চিন্তার দোকানে বসে একটি ছেলেকে খারাপ করছে। ছেলেটি সক্রেটিসের শিক্ষায় নষ্ট হয়ে গেলো।
বাবাকে পিটালো। ... অবশেষে ছেলেটির বাবা সক্রেটিসকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে দিল। কোনমতে পালিয়ে বাঁচল সক্রেটিস।
এ নাটক দেখতে দেখতে থিয়েটারে বসেই কাঁদলো প্লেটো। মঞ্চে এরকম ভাবে কেউ সক্রেটিসকে দেখাতে পারে,
সেটা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এমন মিথ্যা কথা মানুষ লিখতে পারে? এটা কি কোনো মানুষের কাজ?
এ নাটক লিখেছে এরিস্টোফানিস। খুবই প্রতিভাধর নাট্যকার।
তার মতো লেখক যদি এমন মিথ্যা নাটক লিখে, তাহলে অন্যদের কী অবস্থা! তো নাটক মানেই মিথ্যা।
কবিতা মানেই বানানো। নাটক, কবিতা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। সক্রেটিসের মতো দেবতাতুল্য মানুষকে নিয়ে যদি এমন নাটক লিখে, তাহলে সাহিত্যিকরা পারে না এমন কোনো জিনিস নেই।
থিয়েটার থেকে বের হয়ে প্লেটো বাড়ি ফিরে গেল না। সরাসরি সক্রেটিসের বাড়ি গেল। তার চোখ এখনও ছলছল করছে। .........
বাড়ি ফিরে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলো প্লেটো। সে যত কবিতা আর নাটক লিখেছিল সব এনে উঠানে জড়ো করল।
এ বয়স পর্যন্ত সে যা কিছু লিখেছিল সব কিছু একত্র করল। উঠানে পেপিরাসের বিশাল স্তুপ হয়ে গেল।
বাড়ির লোকেরা কিছু বুঝতে পারছেন না। ছেলে কী করছে। কিছু মনে হয় হারিয়ে গেছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখা মনে হয় খুঁজছে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই পেপিরাসের স্তুপে আগুন জ্বালিয়ে দিল প্লেটো। সবাই হায় হায় করে ওঠল।
সন্ধ্যার আঁধার আলো করে জ্বলে ওঠল প্লেটোর এত বছরের লেখা। তার মা কাঁদছেন।
ছেলে পাগল হয়ে গেল। বাবা বলেছিল, এই ছেলে একদিন হোমারকে ছাড়িয়ে যাবে,
একদিন সফোক্লিসের চেয়ে বড় নাট্যকার হবে। আর সেই ছেলে তার সব লেখা পুড়িয়ে দিল!
সবাই আফসোস করছে। শুধু প্লেটো হাসছে। শান্তির হাসি। তার নতুন জীবন শুরু হচ্ছে।
সে আর কোনোদিন কবিতা লিখবে না। নাটক লিখবে না। কবিতায়, নাটকে মিথ্যা কথা লিখা হয়।
সে আর এসব কিছু লিখবে না। যদি কিছু লিখে, সেটা হলো সক্রেটিসের মুখের কথা, সক্রেটিসের দর্শন। সেগুলো সব সত্য, কোনো মিথ্যা কিছু আর সে লিখবে না।
রাতের আকাশ আলো করে জ্বলছে প্লেটোর লেখা সব কবিতা। পুড়ছে তার লেখা সব নাটক। এথেন্সের বাতাসে ভাসছে কবিতা পোড়ার গন্ধ।
আগুনের শিখা ছুঁয়ে প্লেটো মনে মনে দৃঢ়ভাবে বলছে, পৃথিবীতে আর কোনো কবি থাকবে না, কোনো কবিতা থাকবে না। কোনো নাটক থাকবে না, কোনো নাট্যকারও থাকবে না। আমি যদি কোনদিন একটা আদর্শ নগর তৈরি করতে পারি, সেই নগরে কোন কবি থাকবে না, কোন নাট্যকার থাকবে না। যারা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা লিখে, আমার নগরে তাদের কোন স্থান হবে না। আমি সেই নগর থেকে সকল মিথ্যাবাদী কবি-সাহিত্যিককে নির্বাসন দেবো।
এই সন্ধ্যায় এথেন্সের নিকষ আঁধার ভাসিয়ে জ্বলছে অদ্ভুত এক আগুন। সেই আগুনে খড়কুটোর মতো পুড়ে যাচ্ছে একজন কবি, মোমের মতো গলে যাচ্ছে একজন নাট্যকার, ছাই হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা একজন সাহিত্যিক। আর সেই ছাইয়ের ভগ্নস্তুপ থেকে জন্ম নিচ্ছে একজন সুকঠিন দার্শনিক, তার নাম প্লেটো।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
এরপর সিম্পোজিয়ামে কথা বলবেন সক্রেটিস। তিনি শুরু করলেন, ‘ভালোবাসা বিষয়ে আমার গুরু হলেন ডিওটিমা। ভালোবাসা নিয়ে আমি যা কিছু শিখেছি, সেটি তার কাছ থেকেই। অনেক বছর আগে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন। তিনি আমাকে ভালোবাসা নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। আজ সব মনে নেই। যতটুকু মনে আছে বলছি-
ভালোবাসার বাবার নাম ঐশ্বর্য। আর মা হলেন দারিদ্র্য বা অভাব। ভালবাসা তার বাবা মা দুজনের বৈশিষ্ট্যই পেয়েছে। ভালোবাসার বাবা ঐশ্বর্য মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য মানে ক্ষমতা। সেজন্য ভালোবাসার অনেক ক্ষমতা, অনেক শক্তি। তুমি ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করতে পারবে। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো শক্তিশালী জিনিস আর নেই। আর ভালোবাসার মা হলেন অভাব। সেজন্য ভালোবাসার চারপাশে সবসময় একটা অভাব। মানুষ প্রেমে পড়লে শুধু চাই আর চাই। তাই ভালোবাসার সাথে সবসময়ই একটা অভাব জড়িয়ে থাকে, সব সময় একটা না পাওয়ার ব্যাপার থাকে। ভালোবাসার জন্ম হয়েছে সৌন্দর্যের দেবীর জন্মদিনে। সেজন্য ভালোবাসা সব সময় সুন্দরের খোঁজ করে। যেখানেই সুন্দর কিছু আছে, সেখানেই ভালোবাসা। ভালোবাসা হলো ঐশ্বর্য আর অভাবের সন্তান। এই দুটো হলো পুরোপুরি বিপরীত। ঐশ্বর্য্য সুন্দর আর অভাব অসুন্দর। ভালোবাসার যেমন সুন্দর করার ক্ষমতা আছে, তেমনি কিছু অসুন্দর করার ক্ষমতাও আছে। ভালোবাসা যেমন মঙ্গল করে, তেমনি হিংসারও জন্ম দেয়। তাই ভালোবাসা শান্তি আনে, তেমনি ভালোবাসা থেকে যুদ্ধও হয়।’
সক্রেটিস আবার বললেন, আমার গুরু ডিওটিমা ভালোবাসার ধাপগুলো বলেছেন। সেটিও চমৎকার। তিনি বলেছেন-
মানুষ প্রথমে দেহের সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে। সবাই এভাবেই শুরু করে। এরপর আর একটু জ্ঞান বাড়লে, আর শরীরের সৌন্দর্য না, মনের সৌন্দর্য খোঁজে। সেটা আর একটু উচ্চ পর্যায়ের ভালোবাসা। মানুষ যখন আরও একটু বুঝতে শিখে, তখন সে জ্ঞানকে ভালোবাসতে শুরু করে। এক সময় সে হয়ে যায় জ্ঞানের প্রেমিক। আর জ্ঞানের প্রতি প্রেমই হলো সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের ভালোবাসা। জ্ঞানের প্রেমিক হলেন দার্শনিক বা ফিলোসফার (Philosopher)। ফিলিন (philein) মানে ভালোবাসা আর সফি (Sophie) মানে জ্ঞান। ফিলোসফার হলেন যিনি জ্ঞানকে ভালোবাসেন। জ্ঞানপ্রেমিক। তাই ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণা হয়, মানুষ দার্শনিক হয়ে যায়।’
... ...
প্রেমের এই দিকটা প্লেটোর খুব মনে ধরলো। জ্ঞানের প্রতি প্রেম বিষয়টি তার খুবই ভালো লাগল। ... সক্রেটিসের সিম্পোজিয়ামের কথা শুনার পর সে শুধু এটা নিয়েই ভাবছে। সে কিছুদিন চিন্তা করল। তারপর সে প্রেমের একটা নতুন ধারণা বলল। সে প্রেমে কোনো কামনা নেই। কোন শরীরের আকর্ষণ নেই।
প্লেটোর বন্ধু ফিদো বলল, এরকম প্রেমের ভাবনা এসেছে প্লেটোর মাথা থেকে। তো এই প্রেমের নাম হোক প্লেটোনিক প্রেম। ...
সক্রেটিসকে ডিওটিমা যেরকম প্রেমের কথা বলেছিলেন, সে রকম প্রেম। কোনো কামনা নেই। শরীর কোনো বিষয়ই না। প্রেম হবে একটা আত্মার ব্যাপার। পবিত্র একটা অনুভূতি। যাকে ছোঁয়া যায় না। যে ছুঁতে চায়ও না। কবিরা বলেন, খাঁটি প্রেমে নাকি একটুকু ছোঁয়া লাগে, কিন্তু প্লেটোনিক প্রেমে একটুকুও ছোঁয়া লাগে না। একেবারে-
‘প্রেমের পবিত্র শিখা চিরদিন জ্বলে,
স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে’
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
ডাক্তার হিপোক্রাটিস বললেন, তোমরা সবাই নির্ভয়ে বসো। তোমরা কেউ চোর না। তোমাদের বকা দেওয়ার জন্য এটা লিখিনি।
ভালো করে শিরোনাম দেখো। কি লেখা আছে?
ছাত্ররা পড়লো, ‘চিকিৎসা বিদ্যার শপথ’।
ডাক্তার হিপোক্রাটিস বললেন, ‘হুম, এটা হলো সব চিকিৎসকদের জন্য শপথ। এটা তোমার আমার ব্যক্তিগত কিছু না।’
ছাত্রদের মনে সাহস ফিরে এলো। তারা একে অন্যের মুখে তাকাচ্ছে।
এরপর ডাক্তার তার ডাক্তারি জীবনের কিছু ঘটনা বললেন। তিনি বললেন, চিকিৎসা হলো জীবন নিয়ে কারবার। মানুষের নাড়ির খবর নেওয়া, হাঁড়ির খবর নেওয়া। চিকিৎসকরা যদি অসৎ হন, সেটা হবে ভয়ংকর। তাই একটা নিয়ম লাগবে। আমরা সবাই দেবতাদের কাছে এই শপথ নিয়ে চিকিৎসা করতে বের হবো। অক্ষরে অক্ষরে মানবো এই শপথ।
ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। তাদের খুব ভালো লাগছো। বড় ডাক্তার এথেন্সে এসে ভাষণ দেওয়া শিখে গেছেন। এথেন্সে নেতারা ছুঁতানাতায় ভাষণ শুরু করে। কিছুদিন এখানে থাকলে আর কিছু শিখুক আর নাই শিখুক, ভাষণ যে শিখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ছাত্রদের ভয় কেটে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে, ওস্তাদ আরেকবার সত্যিকার ওস্তাদের মতো কাজ করেছেন। যেভাবে তিনি দেবতাদের বাদ দিয়ে রোগ নির্ণয়ে রোগীর দেহ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, যেভাবে সবার জন্য চিকিৎসা বিদ্যালয় করেছেন, সেভাবেই আর একটি বিশাল কাজ করলেন। তিনি চিকিৎসকদের নৈতিকতা ধরে রাখতে একটি শপথ লিখে ফেলেছেন।
একজন ছাত্র বলল, আমার মনে হয়, এই শপথের নাম হোক ‘হিপোক্রাটিক শপথ’।
সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠলো। এর থেকে ভালো নাম আর হতে পারে না। একজন বলল, এই শপথ সবার ঘরে ঝুলিয়ে রাখবো।
আরেকজন বলল, আমাদের হাসপাতালের সামনে পাথরে খোদাই করে দেবো।
ডাক্তার বললেন, সবই করা যাবে, আগে শপথ চূড়ান্ত হোক।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
এই নাটকখোর ইউরিপিডিস সক্রেটিসের বন্ধু। তাদের বন্ধুহওয়ার কথা নয়। দুজনের স্বভাব পুরোপুরি উল্টা। দুজন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। সক্রেটিস মহাআড্ডাবাজ। নিজে বকবক করে, মানুষকে দ্বিগুণ বকবক করায়। ইউরিপিডিস মিতভাষী, সে আড্ডা পছন্দ করে না। প্রতিদিন নাটক দেখে, আর ফাঁক পেলেই লিখতে বসে। সক্রেটিস লেখালেখির ধারে-কাছেও নেই। পেপিরাস কাগজের উপর কলম ছোঁয়াতে তার কষ্ট লাগে। দুজনের সবচেয়ে বড় অমিল হলো বয়সের। সক্রেটিসের সব বন্ধু তারচেয়ে বয়সে ছোট। ইউরিপিডিস তার একমাত্র বেশি বয়সের বন্ধু। সে সক্রেটিসের চেয়ে পনেরো বছরের বড়। ইউরিপিডিস আসলে সক্রেটিসের ভক্ত। সক্রেটিস নতুন নতুন কথা বলে। এমন কথা অন্য কেউ বলে না। কবি-সাহিত্যিকরা সব সময় নতুন কথা খোঁজেন। সে অনেক নতুন কথা পায় সক্রেটিসের কাছে।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
ইউরিপিডিস আড্ডার জন্য জুতসই লোক নয়। সে আড্ডা নষ্ট করে। সে সব সময় বড় বড় জিনিস নিয়ে আলাপ করে।
উচ্চস্তরের কথাবার্তা বলে। আড্ডার জন্য উচ্চস্তরের কথা ক্ষতিকর। আড্ডায় দরকার তুচ্ছ কথা, টুকরা আলাপ। ইউরিপিডিস কোনো ধরনের টুকরা আলাপে নেই। তার সবকিছু উচ্চপর্যায়ের। ইউরিপিডিস নিজে জানে যে সে আড্ডার জন্য উপযোগী নয়। তাই সে আড্ডায় বেশি কথা বলে না, চুপচাপ শোনে। কিন্তু যেদিন সে কথা শুরু করে, সেদিন সবাই বুঝে যায় যে আজ আর কারও কোনো সুযোগ নেই, আজ সব কথা সে একাই বলবে। সেসব কথা উচ্চস্তরের সাহিত্যের কথা। তখন আর উপায় নেই, সবাই মুখে কুলুপ দিয়ে তার কথা শোনে। আজ ইউরিপিডিস কথা শুরু করেছে। তাই অন্য সবার মুখে কুলুপ। সক্রেটিসের মুখেও কুলুপ। সে মনে মনে বলছে ইউরিপিডিস যেন আজ হোমারের বই নিয়ে আলাপ শুরু করে। হোমারের লেখা সে খুব সুন্দর করে বলতে পারে।
ভাগ্য ভালো। ইউরিপিডিস হোমারের লেখা নিয়েই কথা বলছে। সে নাটকের মতো ঘটা করেই শুরু করেছে ট্রয় যুদ্ধের কথা। তার প্রিয় বই হোমারের ‘ইলিয়াদ’। সে এখন ইলিয়াদ আবৃত্তি করবে। সেটি বুঝতে পেরে সক্রেটিস বলল, আজকের আড্ডার একটি নাম দিই। নাম হোক ‘হোমারের আকাশে এক ঝাঁক যুবক’।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
আজ ইউরিপিডিস কথা শুরু করেছে। তাই অন্য সবার মুখে কুলুপ। সক্রেটিসের মুখেও কুলুপ। সে মনে মনে বলছে ইউরিপিডিস যেন আজ হোমারের বই নিয়ে আলাপ শুরু করে। হোমারের লেখা সে খুব সুন্দর করে বলতে পারে। ভাগ্য ভালো। ইউরিপিডিস হোমারের লেখা নিয়েই কথা বলছে। সে নাটকের মতো ঘটা করেই শুরু করেছে ট্রয় যুদ্ধের কথা। তার প্রিয় বই হোমারের ‘ইলিয়াদ’। সে এখন ইলিয়াদ আবৃত্তি করবে। সেটি বুঝতে পেরে সক্রেটিস বলল, আজকের আড্ডার একটি নাম দিই। নাম হোক ‘হোমারের আকাশে এক ঝাঁক যুবক’।
সিমন বলল, হোমারের আকাশে ঢোকার শুরুতে বলো, ট্রয় যুদ্ধের জায়গাগুলো ঠিক কোনখানে?
ইউরিপিডিস বলল, কোনখানে? মানে আমাকে এখন ভূগোল বলতে হবে? ঠিক আছে, ইতিহাস থাক, আগে ভূগোল। তো শোন, ট্রয় যুদ্ধের ভূগোল হলো তিনটি প্রধান শহর নিয়ে। সেগুলো হলো ট্রয়, স্পার্টা আর মাইসিন। ট্রয় শহরটি আমাদের ঠিক নাক বরাবর। ওদিকে তাকাও, এথেন্স থেকে এজিয়ান সাগরের ঠিক উল্টা পাড়েই ট্রয়। স্পার্টা হলো এথেন্স থেকে আড়াইশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি শহর। স্পার্টার রানি হেলেন ছিলেন বিশ্ব সুন্দরী। সুন্দরী হেলেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের প্রেমে পড়ে ট্রয় নগরর পালিয়ে যায়। প্রতিশোধ নিতে হেলেনের স্বামী স্পার্টার রাজা মেলেনাউস ছুটে এলো তার বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই মাইসিন নগরের রাজা আগামেমনন। আগামেমনন গ্রিসের সব নগরের মানুষকে নিয়ে একটি বিশাল সেনাবাহিনী একত্র করল মাইসিন শহরে। মাইসিন শহরটি এথেন্স থেকে নব্বই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। এই মাইসিন থেকেই গ্রিক বাহিনী জাহাজে করে ট্রয় আক্রমণ করে। যুদ্ধটা হয়েছিল ট্রয় নগরেই।
সিমন বলল, বাহ, তুমি তো ভূগোলে একেবারে দশে দশ। কোন জায়গা কোন দিকে, কত দূরে সব মুখস্ত।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়?’
সক্রেটিস আর ক্রিতো একসাথে প্রশ্নটি করল। সামনে ষাট বছরের বৃদ্ধা ডিওটিমা। ভালোবাসা কী জিনিস, সেটি জানতে তারা ডিওটিমার কাছে এসেছে। দিনের আলো কমে এসেছে। সন্ধ্যার আগে গোধূলির আলো নিভু নিভুকরছে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিমাখা নিভুনিভুআলোতে তারা প্রেমের সংজ্ঞা বের করতে চাইছে।
ডিওটিমা একজন রহস্যময় নারী। তিনি জিউসের মন্দিরের পুরোহিত। মুখ দেখে ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। একবার তাকিয়েই কার ভাগ্যে কী আছে, ফটাফট বলে দিতে পারেন। তার কাছে লাইন ধরে লোক আসে। তিনি কাউকে বিশেষ কিছুই বলেন না। তবে যা বলেন, সেটি মিথ্যা হয়েছে এমন নজির নেই। লোকে তাকে বুঝতে পারে না। তিনি রহস্যময়ী নারী। এই রহস্যময়ী নারীর কাছে আসার জন্য ক্রিতো কয়েক দিন ধরে সক্রেটিসের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। ক্রিতোর বিয়ে হবে। তার মা-বাবা মেয়ে দেখতে শুরু করেছেন। খুব তোড়জোড় চলছে। বিয়ের আগে ক্রিতোর একটু প্রেম বিষয়ক জ্ঞান দরকার। ভালোবাসা বিষয়ক জ্ঞানের জন্য তারা এখন এসেছে ডিওটিমার আখড়ায়।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
আজ শেষ রাতে তার অনেক কিছু মনে পড়তে লাগল। স্বামীর সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করেছেন। অকারণে রাগ করেছেন। গালি দিয়েছেন। এক-একটা ঘটনা মনে পড়ছে, আর কান্না পাচ্ছে। জেনথিপি কাঁদছেন। সারা জীবনের রাগের জন্য কাঁদছেন।
সক্রেটিস অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছেন না। সারা জীবনের অপরাধ এক রাতের কান্নায় ভাসিয়ে দিতে চাইছেন জেনথিপি। কিন্তু সেটার কোনো দরকার নেই। তার ওপর সক্রেটিসের কোনো রাগ নেই। বরং সক্রেটিস ভাবছেন - সারা জীবন এই মেয়েটিকেই শুধু কষ্ট দিয়েছেন। দুনিয়ার সব মানুষের জন্য সুন্দর জীবন খুঁজেছেন। শুধু জেনথিপিকে দিয়েছেন একটি অসুন্দর জীবন। সক্রেটিসেরও কান্না পাচ্ছে।
দুজন দুজনের দুঃখে কাঁদছেন। রাত বয়ে চলছে। একটা ঝিরঝির বাতাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। খুব কাছেই একটা কুকুর ডাকছে। মনে হচ্ছে কুকুরটিও কাঁদছে। কুকুরের মতো প্রাণীদেরও কি বিরহ আছে? সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে একলা ফেলে চলে যাওয়ার বেদনা আছে?
অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটলো। জেনথিপি বারবার বাইরে তাকাচ্ছেন। তার ভয় - কখন যেন আকাশ ফরসা হয়ে যায়! রাতটি শেষ হয়ে যায়।
হঠাৎ সক্রেটিস বললেন, তুমি কখনো হেমলক গাছ দেখেছো?
জেনথিপি হেমলক গাছ দেখেননি।
সক্রেটিস বললেন, এই জেলখানার দারোয়ানের খুব আগ্রহ সে আমাকে হেমলক গাছ দেখাবে। আজ রাতেই আনার কথা। তুমি আছ বলে ঢোকার সাহস পায়নি। দাঁড়াও ডাক দেই।
জেনথিপি বললেন, এত রাতে ঘুমিয়ে লোকটা ঘুম আছে নিশ্চয়ই।
সক্রেটিস বললেন, ও রাতের দারোয়ান। ওর কাজই রাতে জেগে থাকা। আমি প্রতি রাতে ওর সাথে কথা বলি।
কিছুক্ষণ পরেই দারোয়ান আসলো। তার হাতে একটি হেমলক গাছের ডাল। সে হাতে দস্তানা পরেছে। এই গাছ মারাত্মক বিষ। গাছের কোনো অংশে হাত লাগালেও বিপদ।
দ্বাররক্ষী বলল, আমি এই গাছ নিয়ে আসছি সেই সন্ধ্যায়। আপনাকে একা পাইনি।
সক্রেটিস আর জেনথিপি দেখছেন হেমলকের গাছের ডাল।
দ্বাররক্ষী খুব উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে। সে এই গাছের একজন বিশেষজ্ঞ।
সে বলল, এই যে দেখেন, চিকন ডাঁটার মতো একটা কাণ্ড। কাণ্ডের দুপাশে সমান পাতা। পাতাগুলো উজ্জ্বল সবুজ। গাজরের পাতার মতো। শুধু কাণ্ডের নিচের দিকে একটু বেগুনি ছিটছিট আছে। একটু লালচে ফোটা ফোটা দাগও আছে।
সক্রেটিস বললেন, বিষ হয় কোনখানে?
দ্বাররক্ষী বলল, সারা গাছই বিষ। যেখানে যত রস হয়, সব বিষ। পাতায় বিষ, ডাঁটে বিষ, ফুলেও বিষ। হেমলক ফুল হয় সাদা সাদা। ফুলগুলো কুট্টি কুট্টি ছাতির মতো। ফুলে রস হয়। তবে সেই রসের বিষ তত ভাল না। সবচেয়ে ভালো বিষ হয় ফলের রসে। হেমলক ফল ছোট্ট ছোট্ট বাদামি রঙের। গ্রীষ্মের শেষে ফল ধরে।
সক্রেটিস বললেন, পুরো গাছটি দেখতে কেমন?
দ্বাররক্ষী বলল, গাছটি বেশি লম্বা হয় না। বেশি হলে মানুষের সমান উঁচু হতে পারে। আপনি তো বেশি লম্বা না। হেমলক গাছ আপনার থেকে অল্প একটু লম্বা হতে পারে।
সক্রেটিস হাসতে হাসতে বললেন, এটা একটা কথার মতো কথা বলেছ। হেমলক গাছ লম্বায় সক্রেটিসের চেয়ে বড়। সক্রেটিসের উচ্চতা হেমলকের থেকে কম।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
জেনথিপি হাসিঠাট্টায় যোগ দিতে পারছেন না। মন খুব খারাপ। সকাল হতেই তিনি এই ঘরে কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছেন। এটাই মনে হয় মৃত্যু গন্ধ। মরণের আগে এরকম গন্ধ পাওয়া যায়। তিনি ভেবেছিলেন, সময় হলে সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন কিনা। সে সময় আর হলো না। আলো না ফুটতেই রাজ্যের ছেলেপেলে ঘরে ঢুকে গেছে। তারা এখন জ্ঞানের কথা বলবে। এটা এখন দর্শনের স্কুল। শেষ দিনের স্কুল তারা কামাই করবে না। সক্রেটিস তাদের নিয়ে মেতে উঠেছেন।
হঠাৎ বুক ফেটে কান্না পেল জেনথিপির। মৃত্যু গন্ধটা তাকে উতলা করে তুলেছে। জেনথিপি কোনো কিছুই ধীরে সুস্থে করতে পারেন না। তিনি চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন।
জেনথিপির কান্না সবাইকে ছুঁতে শুরু করেছে। সবাই মনে হয় মৃত্যু গন্ধটা পাচ্ছে। সবার মুখে গম্ভীর হয়ে গেলো। সক্রেটিস দেখলেন, সর্বনাশ, কখন জানি জেনথিপির সাথে সবাই কান্না শুরু করে! কান্নার কোরাস হয়ে যাবে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কী বলা যায়? সক্রেটিস অনেক যুক্তি জানেন। কিন্তু যে মেয়ের স্বামী একটু পরে মারা যাবে, তাকে কান্না থামাতে বলার মতো যুক্তি সক্রেটিসের জানা নেই।
জেনথিপির দিকে এগিয়ে গেলো ক্রিতোর ছেলে ক্রিতোবুলাস। ক্রিতো এখনো আসেননি। ছেলে ক্রিতোবুলাস সকালের খাবার নিয়ে এসেছে। এই ছেলেটি জেনথিপিকে মায়ের মতো দেখে। জেনথিপিরও তার কাছে লজ্জা নেই। ক্রিতোবুলাস জেনথিপিকে একটা রুমাল দিল।
জেনথিপি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছেন, ও সক্রেটিস, তোমার বন্ধুদের সাথে এই তোমার শেষ কথা। এই শেষ দেখা। আর কোনোদিন তর্ক করতে পারবে না। আর কোনোদিন একসাথে আগোরায় বসবে না। আড্ডা দিবে না। এথেন্স যেমন আছে, তেমনই থাকবে। ঐ আগোরা থাকবে, আড্ডা থাকবে। শুধু সক্রেটিস থাকবে না।
তরুণরা হায় হায় করছে। এক্ষুণি কান্নার কোরাস শুরু হবে।
সক্রেটিস তাড়াতাড়ি বললেন, তুমি এখন বাড়ি যাও। বিকেলে আবার এসো। এখানে অনেক মানুষ, আরও ছেলেরা আসবে। সবাই কান্নাকাটি করলে জেলখানার দারোয়ান ঝামেলা করবে। তুমি যাও।
ক্রিতোবুলাস জেনথিপিকে বলল, চলেন, আমি আর সফ্রোনিকাস আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
জেনথিপি বেরিয়ে গেলেন। তার মনে হচ্ছে - মরণ গন্ধটা তার সাথে সাথেই যাচ্ছে। গন্ধটা নাকে যেতেই তিনি কেঁপে উঠছেন।
কেঁপে কেঁপে কাঁদছেন। তার সাথে কোলের ছেলেটাও কাঁদছে।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
জেনথিপিকে কী বলবেন বুঝতে পারছেন না সক্রেটিস।
সময় বেশি নেই। ঠিক সূর্যাস্তের পরেই বিষ খেতে হবে। কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেলো। কিছু না বলেই অনেক কিছু বলছেন দুজনে।
জেনিথিপি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?
সক্রেটিস বললেন, গন্ধ? জেলের কুঠুরি, অপরিষ্কার। গন্ধ তো হবেই।
‘না না, অন্য রকম গন্ধ। একটা মরণ মরণ গন্ধ।’
‘মরণ মরণ গন্ধ? তুমি ভুল-ভাল দেখছ। ভুল গন্ধ পাচ্ছ। বেশি চিন্তা করো না। শোন, হেমলকের গন্ধ হলো ইঁদুরের মতো গন্ধ। মরণ গন্ধ বলতে কোনো জিনিস নেই।’
এ কথাটা বলার কিছুক্ষণ পরেই সক্রেটিস কেমন একটা গন্ধ পেতে করলেন। রাগ হলো জেনথিপির উপর। কী সব গন্ধের কথা বলে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এসব মন থেকে দূরে রাখতে তিনি ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। ক্রিতোকে ডেকে ছেলেদের নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা আরম্ভ করলেন।
জেনথিপি কাঁদছেন। কখনো আস্তে, কখনো জোরে।
সক্রেটিস ভাবছেন তিনি মারা যাবার পর জেনথিপি যে চিৎকার করে কাঁদবে, তাতে মানুষের কাছে সম্মান যাবে। তার চেয়ে জেনথিপি মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাক।
কথাটা ভয়ে ভয়ে বলতেই জেনথিপি রাজি হয়ে গেলেন। তিনি নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। তার চোখে কোনো পানি নেই। নেই কোনো অভিমান। আর কিছুক্ষণ পরে তার স্বামী চিরতরে চলে যাবেন। স্বামীর মৃত্যুর সময় তিনি সামনে থাকবেন না। তার তেত্রিশ বছরের সংসার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনটি নাবালক সন্তান নিয়ে কীভাবে চলবে, তাও জানেন না। তবু জেনথিপি নীরবে বের হয়ে যাচ্ছেন। কারাগারের ছোট্ট কুঠুরিরে রয়ে যাচ্ছে তার সংসারের শেষ চিহ্ন। সেই চিহ্ন পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছেন জেনথিপি। জেলখানার বাইরে এখন অনেক লোক। সবাই সক্রেটিসের মৃত্যুর খবর নিতে এসেছে। তাদের সামনে দিয়ে নীরবে হেঁটে যাচ্ছেন জেনথিপি।
সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় জেনথিপির না থাকলেও চলবে। সক্রেটিস সারাজীবন মানুষের জন্য ভেবেছেন। মানুষের জীবন সুন্দর করতে চেয়েছেন। তাই তার জীবনের শেষ মুহূর্তের স্বাক্ষী থাকুক হাজারো মানুষ। সেখানে জেনথিপির কোনো প্রয়োজন নেই। জেনথিপি একবার পেছন ফিরে তাকালেন। যদি একবার সক্রেটিসকে দেখা যায়! না, এখান থেকে জেলখানার ছোট্ট কুঠুরির ভেতরে সক্রেটিসকে দেখা যায় না। এবার বুক ফেটে কান্না এলো জেনথিপির। এ জীবনে স্বামীকে আর জীবিত দেখতে পাবেন না। স্বামীর সাথে তার হিসাব-নিকাশ শেষ হয়ে গেছে। তিনি চারদিকে তাকালেন।
জেলখানার বাইরে শত শত মানুষ। তাদের সবার মুখে একটাই শব্দ - সক্রেটিস। অনেকেই কান্না শুরু করে দিয়েছে। তাদের অশ্রুভরা মুখের দিকে তাকিয়ে জেনথিপির মনে হলো - যে মানুষটির জন্য এতো লোক কাঁদছে, তিনি নিশ্চয়ই এই মানুষদের কিছু না কিছু দিয়েছেন। তাহলে সক্রেটিসের সুন্দর জীবনের সাধনা সার্থক হয়েছে। তার জন্য সবাই কাঁদছে। এখানে সবাইকে দেখিয়ে জেনথিপির কান্নার দরকার নেই। জেনথিপি ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন। সে কান্না তার একান্ত কান্না। সে কান্না কেউ দেখবে না। জেনথিপি আকাশের দিকে তাকালেন। দিন প্রায় শেষ।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
#
ক্রিতো সক্রেটিসের চোখ আর মুখ বন্ধ করে দিলেন। বিদায় নিলেন পৃথিবীর মহত্তম মানুষ। বিদায় নিলেন পৃথিবীর প্রথম শহীদ; যিনি সত্য, ন্যায় আর বাকস্বাধীনতাকে স্পর্শ করেছিলেন।
সারা ঘরে কান্নার রোল। সক্রেটিসের সব বন্ধু একসাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আকাশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। জেলখানার ভেতর প্রতিটি মানুষ কাঁদছে। বিষ-জল্লাদ বিলাপ করছে। জেলার সাহেব মাথা নিচু করে আছেন। তার চোখ দিয়ে নি:শব্দে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি। জেলখানার বাইরে শত শত মানুষ - সবার চোখে পানি। এথেন্সের গণতন্ত্রের অশ্রু ঝরছে, সংসদের প্রতিটি পাথর কাঁদছে। বিচারকক্ষ, জলঘড়ি সব নিশ্চুপ হয়ে আছে। যেসব বিচারক সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, আজ তারাই সবচেয়ে বেশি কাঁদছেন।
ক্রিতো তাকিয়ে আছেন সক্রেটিসের মুখখানার দিকে। এই মুখ সারা জীবন সত্য আর সুন্দরের কথা বলে গেছেন, ভালোবাসার কথা বলে গেছেন। কিন্তু একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেননি। মরার পর সক্রেটিসের দেহ মাটি দেয়া হবে, নাকি পোড়ানো হবে - সেই সিদ্ধান্ত সক্রেটিস ক্রিতোকে বলেননি। এটা ক্রিতোর উপর দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই বিশাল সিদ্ধান্ত ক্রিতো কিভাবে নিবেন? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ একজনই আছেন, তিনি হলেন জেনথিপি।
কিন্তু কোথায় জেনথিপি? মৃত্যুর আগে সক্রেটিস তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিলো জেনথিপি চিৎকার করে কাঁদবেন। কিন্তু জেনথিপি কাঁদেননি। বাড়ি ফিরে তিনি শুভ্র কাপড় পরে কিছুক্ষণ বসেছিলেন উঠানের জলপাই গাছের নিচে। এখন চলছেন কেরামিকাসের পথে। কেরামিকাসে এথেন্সের সমাধি। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হবে সক্রেটিসের দেহ। পোড়ানো নাকি কবর? সেই সিদ্ধান্ত শুধুই জেনথিপির। সক্রেটিসের জীবনের কোন সিদ্ধান্তই জেনথিপি নেন নি। এই শেষ সিদ্ধান্তটি তিনিই নিবেন।
সক্রেটিসের দেহ চলেছে সমাধির পথে। আঁধারের ঘোমটা মাথায় দিয়ে জেনথিপিও হাঁটছেন সমাধির দিকে। তিনি কাঁদছেন না। শুধু তার পায়ে পায়ে কাঁদছে কতগুলো শুকনো জলপাই পাতা। সন্ধ্যার আঁধার ছাপিয়ে একটি পাখি নিদারুণ করুণ সুরে ডাকছে। পাখির কণ্ঠে দুনিয়ার সমস্ত বিরহ ঝরে ঝরে পড়ছে। এজিয়ান সাগরের উষ্ণ বাতাস ভিজে উঠেছে। মহাকালের গহবর থেকে ভেসে আসছে অচেনা একটা মরণ-মরণ গন্ধ।
একটি অবিনশ্বর মৃত্যুর জ্যোতি নিয়ে অদ্ভুত আঁধার নামছে পৃথিবীতে। সেই আঁধারের গা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়ছে মৃত্যু। মহাবিশ্বের মহত্তম কান্নায় ভিজে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত আলো। মরণ সাগরের উপর দিয়ে অনাগতকালের পথ-সন্ধানী মানুষের জন্য নিমন্ত্রণ নিয়ে আসছে একটি পাখি -
পাখিটির ঠোঁটে এক পেয়ালা হেমলক।
// 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' © সুজন দেবনাথ
প্রকাশক:
অন্বেষা প্রকাশন
৯ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
ফোন: ০১৯১১৩৯৪৯১৭
প্রাপ্তিস্থান:
পাঠক সমাবেশ (ঢাকা)
বাতিঘর (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট)।
বইটি অনলাইন থেকে সংগ্রহের জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন