বিশ শতকের শেষ দিকের কথা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঝানু পণ্ডিতদের অবাক করে দিয়ে বার্লিন দেয়াল ধসে গেলো। স্নায়ুযুদ্ধে হেরে গেলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। জিতে গেলো আমেরিকার নেতৃত্বে ক্যাপিটালিস্টরা। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ভুলেও চিন্তা করেননি যে – এমন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে স্নায়ুযুদ্ধ – থেমে যাবে দুই মেরুর বিশ্বব্যবস্থা। আমেরিকা হয়ে যাবে একচ্ছত্র কর্তা। তবু তাই হলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পণ্ডিতরা ভাবলেন – এবার কি হবে? এখন তাঁরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আমেরিকা শাসিত এই নতুন এক মেরুর পৃথিবীকে?
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এই ঘোলা পানিতে সুযোগ পেয়ে গেলো। ভুঁইফোঁড়ের মতো নিয়ে আসলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন তত্ত্ব। বলল – হেরে গেছে সমাজতন্ত্র। ধনতন্ত্র বা ক্যাপিটালিজমের চিরবিজয় হয়ে গেছে। এরপর পৃথিবীতে আসবে শান্তি। ধনতন্ত্রের মধু মাখা অখণ্ড শান্তি। এই প্রেক্ষিতে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ১৯৯২ সালে লিখলেন ‘The End of History and the Last Man.’ তিনি বললেন – ইতিহাস সমাপ্ত হয়েছে। আমেরিকা জিতে গেছে। পৃথিবীতে লিবারেল ডেমোক্রেসিই (উদার গণতন্ত্র) শেষ কথা। এটাই শান্তির একমাত্র পথ। কার্ল মার্ক্স যে বলেছিলেন, শ্রমিকের হাতে ভর করে একদিন কমিউনিজম ক্যাপিটালিজমকে হারিয়ে দেবে – সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ক্যাপিটালিজম জিতে গেছে। এখন থেকে ক্যাপিটালিজম লিবারেল ডেমোক্রেসির ঢাকনা পরে পৃথিবীতে শান্তি ফেরি করে বেড়াবে। বইটার এইসব কথাবার্তা পশ্চিমের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কূটনীতিকদের খুব মনে ধরল। হাটে মাঠে এটা নিয়ে তুমুল আলোচনা। হ্যাঁ ঠিকই তো – জয় হয়েছে। গণতন্ত্রেরই জয় হয়েছে। ইতিহাস সমাপ্ত হয়েছে।
কিন্তু ফুকুয়ামারই শিক্ষক স্যামুয়েল হান্টিংটন দেখলেন – আরে আমার শিষ্যতো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই গুরুমারা শিষ্যকে তো আর বেশিদূর ওঠতে দেয়া যায় না। তো এক সেমিনারে হান্টিংটন বললেন – না না, ইতিহাস শেষ হয়নি। আরেক ইতিহাসের শুরু হয়েছে মাত্র। সেই ইতিহাস হল – ‘The Clash of Civilizations’ – মানে ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’। এখন থেকে শুরু হবে এক সভ্যতার সাথে অন্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব। সেই বক্তৃতার কথা বার্তা নিয়ে লিখে ফেললেন বই। বইয়ের নাম – ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order.’ বইতে দেখালেন – পৃথিবীতে নাকি আলাদা আলাদা আটখানা সভ্যতা আছে – পাশ্চাত্য সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতা, ল্যাটিন সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা এমন। আর এই সভ্যতাগুলো নাকি এখন থেকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। আর এই দ্বন্দ্বই হবে আগামী পৃথিবীর ইতিহাস।
হান্টিংটনের এই বই কূটনীতির বাজারে হলো দারুন হিট। রাতারাতি সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর কূটনীতিকদের অন্দরমহলে আলোচনা শুরু হল – ‘Clash of Civilizations.’ অনেকেই মেনে নিলেন – হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম দ্বন্দ্ব তো আছেই। দ্বন্দ্ব, বিভাজন এসবই আসলে মানুষের পরিণতি।
অল্প কিছু মানুষ এই তত্ত্বকে মানেননি। অমর্ত্য সেন বলেছেন, এই দ্বন্দ্বের চিন্তাধারা মানবতার জন্য অশনি সংকেত। এতে মানুষের ঘরে ঘরে যুদ্ধ পৌঁছে যাবে।
আর হয়েছেও তাই। ওই সভ্যতার দ্বন্দ্বে তাত্ত্বিকভাবে যাই থাকুক না কেন, প্রাকটিকাল প্রয়োগ হিসেবে দেখা গেল – এটাকে আসলে মুসলিম সভ্যতার সাথে অন্যান্য সভ্যতার দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই দিকেই লিখালিখি শুরু হল। শুরু হল শত্রু শত্রু খেলা। কিছু মুসলিম সংগঠনও আনন্দে লাফিয়ে ওঠলো। তাঁদেরও এই দ্বন্দ্বে সাময়িক লাভের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পরিণতি চিন্তা করার মত সময় তাঁদের ছিল না। আর সাধারণ মানুষ কিছুই বুঝল না। কিন্তু এক থেকে দুই দশকের মধ্যে দেখতে পেল, তাঁদের ঘরে বোমা পড়ছে। তাঁদের সন্তান তাঁদের অজান্তেই যুদ্ধ করছে কোন এক পক্ষের হয়ে।
বিষয়টা বুঝতে অনেক নেতারই বেশ সময় লেগে গেলো। বুঝতে পেরে ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ খাতামি এটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ‘সভ্যতার সংলাপ’ (Dialogue among Civilizations) এর কথা বললেন। তাঁর কথার ভিত্তিতেই জাতিসংঘ ২০০১ সালকে ‘ডায়লগ এমোং সিভিলাইজেশান’ বর্ষ ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে স্পেনের প্রেসিডেন্ট জোসে লুইস রড্রিগেজ এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইপে এরদোগান জাতিসংঘে ‘সভ্যতার মৈত্রী’ (Alliance of Civilizations) এর প্রস্তাব করেন। কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে। হান্টিংটনের দ্বন্দ্বের থিউরি বাজার দখল করে ফেলেছে। আর বড় বড় যুদ্ধের বদলে ছোট ছোট যুদ্ধে ছেয়ে গেছে বিভিন্ন মহাদেশ। অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। ধর্মীয় অনুভূতি আর উগ্র জাতীয়তা দেশে দেশে সৃষ্টি করছে তীব্র বিভাজনের সমাজ, দ্বন্দ্বের সমাজ।
আর আমরাও সকল শক্তি দিয়ে উঠে পরে লেগেছি – প্রমাণ করেই ছাড়বো – হান্টিংটনই সঠিক – সহস্র বছর ধরে শান্তির বাণী নিয়ে আসা মনীষীরা ভুল – পৃথিবীতে Clash of Civilizations ই শেষ কথা।
© সুজন দেবনাথ