Select Page

এথেন্স। গণতন্ত্রের জন্মভূমি। মোটামুটি আড়াই হাজার বছর আগে এখানেই একদল মানুষ আবিষ্কার করেছিল গণতন্ত্র। হুম, আবিষ্কারই করেছিলো। এথেন্সের মানুষকে কেউ গণতন্ত্র দান করেনি। এটি তাঁরা পথের পাশে কুড়িয়েও পায়নি। নিজেদের প্রয়োজন থেকেই তাঁরা রাজা-রাণীর শাসনকে অস্বীকার করেছিল। আর তাঁর বদলে নিজেদের শাসন করার দায়িত্ব নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছিল। সেই শাসনের নামই তাঁরা দিয়েছিল গণতন্ত্র।

নিজেদের শাসন করার জন্য এথেন্স নগরের মানুষেরা চিন্তা করলো তাঁরা একটা কমিটি করবে। কমিটি তৈরি করার জন্য তাঁরা একত্রিত হলো এথেন্সের একটি পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়টির নাম প্নিক্স। প্নিক্স পাহাড়ে বসেই তাঁরা ভোট করলো। সরাসরি ভোট। সাদা আর কালো দুই ধরনের পাথরের উপর নাম লিখে কাঠের ব্যালট বাক্সে ফেললো। এভাবে যাদের নাম বেশি উঠলো সেই ৪০০ জনকে নিয়ে তৈরি হলো কমিটি। সেই কমিটি প্নিক্স পাহাড়েই সভা করলো। সেই প্রথম সভা থেকেই পৃথিবীতে শুরু হলো নতুন একটি শাসন ব্যবস্থা, যেটির নাম গণতন্ত্র। আর প্নিক্স পাহাড়ই হলো পৃথিবীর প্রথম সংসদ।

প্রতিদিন এই সংসদের সভা বসতো আর সরাসরি ভোট হতো। সেই ভোটে নির্বাচিত হতেন শাসক বা জনগণের প্রতিনিধি। রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্ত এখানে বসে ওইরকম ভোটের মাধ্যমেই নেয়া হতো। তাঁরা সেই সংসদের দুটি কমিটিও করলো। অনেকটাই আজকের দিনের সংসদের উচ্চকক্ষ আর নিম্নকক্ষের মত। বছরের পর বছর আলোচনা করে তাঁরা মানুষের জন্য আইন তৈরি করলো – ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার আইন। সেই আইন আনুযায়ী বিচারের জন্য তৈরি করলো পৃথক আদালত। এথেন্স নগরের কিছু কৃতি সন্তান যেমন সোলন, ক্লেইস্থিনিস, পেরিক্লিস – এইসব মানুষেরা তৈরি করেছিলো শাসনের এই নতুন মডেল – গণতন্ত্র।
.
১৭৭৬ সালে স্বাধীন হবার পর আমেরিকা তার গণতন্ত্রের জন্য এই এথেন্স মডেলকেই গ্রহণ করেছিল। আমেরিকার কংগ্রেসে এখনো এথেন্সের আইন প্রণেতা সোলনের পাথরের মূর্তি ঝুলছে। সেখানের অনেক সরকারী দপ্তরেই ঝুলানো আছে এথেন্সের আরেক আইন প্রণেতা ক্লেইস্থিনিসের ছবি। আর এথেন্সের পেরিক্লিসকে আমেরিকান পণ্ডিতরা মনে করেন গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ।

আগামী ১৫ ও ১৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর শেষ রাষ্ট্রীয় সফরে এথেন্সে আসছেন। তাঁর আশা – তিনি এথেন্সের প্নিক্স পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিবেন।

আমেরিকার ফরেন পলিসি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে আর সেগুলোর কারণও আমরা জানি। কিন্তু গণতন্ত্র বা ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য আমেরিকান মডেলকে পণ্ডিতরা প্রশংসাই করেন। আর আমি ব্যক্তি ওমাবাকে ভীষণ পছন্দ করি। ২০০৮ সালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন, ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। তখন আমি একজন কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ার। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুই বুঝি না। কিন্তু তারপরও দেখলাম, বারাক হোসেন ওবামা – একজন মুসলিম পিতার সন্তান, একজন অভিবাসী, একজন সংখ্যালঘু, একজন কালো মানুষ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হতে পারলো। এটা পৃথিবীর তথাকথিত অনেক সভ্য দেশেই ভাবা যায় না। সেদিন থেকেই আমেরিকান গণতন্ত্রের মডেলটিকে বেশ আলাদা মনে হয়েছিলো। এরপর একটু একটু করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম – এই আমেরিকান গণতন্ত্র আসলে এথেন্সের গণতন্ত্রের উত্তরসুরী।

ব্রিটিশদেরকে বিতাড়িত করে নতুন রাষ্ট্র গঠন করার সময় আমেরিকানরা দুটি চমৎকার জিনিস সামনে নিয়ে বসেছিলো। একটি হচ্ছে ফরাসী বিপ্লবের দর্শন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের সাহায্য করেছিল ফ্রান্স। তাই ফরাসী দর্শন স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগার কথা। রুশো, ভলতেয়ারদের মত ফরাসী মানবতাবাদীদের দর্শন আমেরিকান সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছিলো। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটা আমেরিকানদের সামনে ছিলো, সেটি হলো – এথেন্সের গণতন্ত্র, সাথে সেখানের সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটলদের দর্শন।

আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা যেমন – থমাস জেফারেসন, এডামস, জর্জ ওয়াশিংটন – এনারা ফরাসী বিপ্লব আর এথেনিয়ান গণতন্ত্রের মডেলকে মিশিয়ে তৈরি করলেন নতুন গঠিত আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামো। সরকার গঠনে তাঁরা মোটামুটি এথেন্স মডেলটিকে একেবারে কপি করে নিয়েছেন। সংবিধান বানাতে ফরাসী বিপ্লবের নীতি, প্লেটোর সাম্যবাদ আর এরিস্টটলের রিয়েলিটি বা বাস্তববাদী দর্শনকে গ্রহণ করেছে। তাই আমেরিকার সংবিধানের মানবিক দিকটি বেশ আকর্ষণীয়।

এখানে একটা কথা বলতে ইচ্চে করছে। আমার মনে হয়, আমেরিকানরা এথেন্সের মডেলটি গ্রহণ করার সময় এতোটাই মুগ্ধ ছিলো যে – দাসপ্রথার মত একটা ভয়ংকর জিনিসকে তাঁরা সেসময় ভুলে গিয়েছিলো। এথেন্সে দাস প্রথা ছিলো। প্লেটো, এরিস্টোটল সবাই দাসপ্রথাকে সমর্থন করে গেছেন। সেই মুগ্ধতা থেকেই হয়তো আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা স্বাধীনতার পরে এটা নিয়ে ভাবেনই নি। হয়তো আমেরিকাতে দাসপ্রথা টিকে থাকার সামাজিক কারণও ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেই দাসপ্রথা বাতিল করার চমৎকার সুযোগ অবশ্যই ছিলো। তখন সেটি না করায়, দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করার জন্য একজন আব্রাহাম লিংকন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আবার সেটা নিয়ে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধও হয়েছে।
.
যাই হোক, ক্ষমতা ছাড়ার আগে প্রেসিডেন্ট বারাম ওবামা এথেন্সের প্নিক্স পাহাড়ে ভাষন দিবেন, এটা আমার চোখে একটা ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। একজন নির্যাতিত সংখ্যালঘু কালো মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে গণতন্ত্রের জন্মভূমিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন, এটা দেখার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু এখন শুনছি নিরাপত্তার ভাবনায় ওবামার প্নিক্স পাহাড়ের ভাষণ বাতিল হতে পারে। সেই ভাষণ তিনি দিবেন এথেন্সের কালচারাল সেন্টারে। কি আর করা! আমি যেখানে বসে লিখছি, সেখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর আর সেখানে আড়াই হাজার পরে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশের প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিচ্ছেন – এটা অনুভব করার আশায় ছিলাম। একটা দারুণ ছবি হতো। এটি না করতে পারলে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর ভবিষ্যৎ আত্মজীবনীর জন্য একটা দারুন কিছু মিস করবেন।
………………………
২.

প্রেসিডেন্ট ওবামা এথেন্সের এক্রোপোলিসের পার্থেনন মন্দির ভ্রমণ করে গ্রিসবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলেন। সুবক্তা মি. ওবামা বেশ আবেগের সাথে উল্লেখ করলেন পৃথিবীর জন্য এথেন্সবাসীর চমৎকার কিছু কাজের কথা। এথেন্স পৃথিবীকে গণতন্ত্র দিয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, সংবিধান, নাগরিকের অধিকার, জনগণের আদালতের মত একেবারে আধুনিক কিছু জিনিস পৃথিবী পেয়েছে এই ছোট্ট পাথুরে নগরী – এথেন্স থেকে। মি. ওবামা সেগুলো প্রায় ধরে ধরে উল্লেখ করলেন। তাঁর ভাষণে তিনি দার্শনিক সক্রেটিস ও এরিস্টোটলকে শ্রদ্ধা জানালেন, ইউরোপের নাটক ও ট্রাজেডির প্রাণপুরুষ এসকিলাস ও ইউরোপিডিসকে স্মরণ করলেন, ইতিহাসচর্চার স্রষ্টা হেরোডটাস আর থুসিডিডের নাম উল্লেখ করলেন আর এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রধানব্যক্তি পেরিক্লিসের বক্তব্য থেকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিলেন।
.
তাঁর এই বক্তৃতার আমার পছন্দের একটা অংশ এমন – “অনেককাল থেকে এসকিলাস ও ইউরোপিডিসের ট্রাজেডি নাটক আমাদের হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে, হেরোডটাস আর থুসিডিডের ইতিহাসচর্চা আমাদের মনকে উন্মুক্ত করছে, পৃথিবীকে আমরা বুঝতে শিখেছি সক্রেটিস আর এরিস্টোটলের কাছ থেকে।”
.
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি প্লেটোর কথা উল্লেখ করলেন না। প্লেটোকে এড়িয়ে গেলেন। কূটনীতিতে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের শব্দচয়ন ভীষণ গুরুত্বপূর্ন। বিদেশ বিষয়ে এইসব বক্তৃতায়ই পররাষ্ট্রনীতি বা কিসে গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটি বুঝা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভাষণ যারা লিখেন, তাঁরা তাঁদের নীতি ভালোভাবেই মাথায় রাখেন।

অনেক দিন ধরেই প্লেটোকে গণতন্ত্রপন্থীরা এড়িয়ে যেতে চান। প্লেটো সাম্যবাদী কিন্তু গণতন্ত্রী নন। প্লেটোর কথা হিটলার ব্যবহার করেছেন, সোভিয়েতরাও ব্যবহার করেছেন। তাই প্লেটোকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে – প্লেটো না থাকলে সক্রেটিস বা এরিস্টোটল কেউই থাকে না। প্লেটো নিজের সকল কথা সক্রেটিসের মুখ দিয়ে বলেছেন। এরিস্টোটলকে পৃথিবী চিনিয়েছেন তিনি। অস্ত্র নয়, জ্ঞানই হবে সিদ্ধান্তের ভিত্তি – এই দর্শন প্লেটোর। আধুনিক যুগে যেটিকে বলা যায় – ক্যান্টনমেন্ট নয়, প্রেসিডেন্ট ভবনই সিদ্ধান্ত নিবেন। তাই প্লেটোকে বাদ দিলে এথেন্স নেই। আধুনিক ব্যক্তি-স্বাধীনতাও নেই।

যাই হোক, প্রেসিডেন্ট ওবামার ইচ্ছা ছিলো তিনি গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘরে ভাষণ দিয়ে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের আদিপুরুষদের স্মরণ করবেন – সেটা তিনি করেছেন। এই অর্থনৈতিক মন্দার সময় তাঁর কথা গ্রিকদের মনে সাহস দিয়েছে – আশার সঞ্চার করেছে।
…………………
// জানুয়ারি, ২০১৭
গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর ও প্রেসিডেন্ট ওবামা //© সুজন দেবনাথ