Select Page

আস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রাণী ক্যাঙ্গারু। ওদের জাতীয় প্রতীকেরও অংশ এটি। বড় বিচিত্র প্রাণী এই ক্যাঙ্গারু। মায়ের পেটের থলিতে করে এরা বাচ্চা পালন করে। একথা আমরা সবাই জানি। আরও অনেক আশ্চর্য বিষয় আছে এই ক্যাঙ্গারুর। যেমন সন্ধ্যার পর রাস্তা পার হবার সময় হঠাৎ চোখে আলো পড়লে এরা একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। এদের স্নায়ু কাজ করে না। দাঁড়িয়ে যায় সেখানেই, সেই রাস্তার মাঝেই। এভাবে প্রতি বছর অনেক ক্যাঙ্গারু রাতের বেলা গাড়ি চাপা পড়ে।

মনে হয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটকর্তাদের চোখেও ওইরকম একটা হঠাৎ আলো পড়েছে। তাই ক্যাঙ্গারুদের মতই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। তাঁদের ক্রিকেট দলকে বাংলাদেশে পাঠাতে ভয় পাচ্ছে। এ নিশ্চয়ই ক্যাঙ্গারুর সেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি। তবে সেটি আলো নয়, আলেয়া। সেটি সত্যি নয়, মরীচিকা। মিথ্যা ভয়ে ঝলসে গেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চোখ। বাংলাদেশের মত ক্রিকেটপ্রেমী দেশে ওরা নিরাপত্তার কথা তুলে বলছে – টিম পাঠাবো না!! সেলুকাস, সত্যিই সেলুকাস!!

হঠাৎ আলোতে ভয় পাওয়া ক্যাঙ্গরুর আচরণ প্রাণী বিজ্ঞানীদের কাছে বড়ই রহস্যময়। তেমনি মিথ্যা জুজুতে অস্ট্রেলিয়ায়ার ভয় পাওয়া ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে বড়ই রহস্যময়।
আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলিঃ
১৫ ডিসেম্বর ২০১৪। প্লেন থেকে সপরিবারে নামলাম সিডনী এয়ারপোর্টে। সেদিন বিকেলের মধ্যেই যেতে হবে রাজধানী ক্যানবেরায়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আমার দুই বছরের পড়াশুনার সমাবর্তন হবে। এডিলেইড থেকে প্লেনে সিডনী হয়ে বাসে চড়ে ক্যানবেরা। একেবারে বিলেত ঘুরে মক্কা যাবার মত। তাই সকাল সকালই বৌ বাচ্চা নিয়ে এসে পড়েছি সিডনীতে।

সকাল ১০.৩০। দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্ম-সূর্যটা তখনও তেতে ওঠেনি। চারদিকে ঝলমলে মিষ্টি আলো। আবহাওয়ার বিচারে যাকে বলে একেবারে সুদিন। হয়তো চণ্ডীদাস এমন এক সকালেই রাধার মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘প্রভাতে উঠিয়া, ও মুখ দেখিলু – দিন যাবে আজি ভালো।’

কিন্তু না, দিনটা ভালো গেল না। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে পুলিশের বাধা। সব রাস্তা বন্ধ। সারা এয়ারপোর্ট পুলিশে ঘেরা। বন্দুক হাতে সিপাহীদের সাজ সাজ রব। মানুষের মাঝে চাপা উত্তেজনা। চারদিকে আতঙ্ক।

ভয়ে ভয়ে খোঁজ নিলাম। যা শুনলাম, তাতে রক্ত আরো হিম হয়ে গেল।

সিডনির সবচেয়ে জমজমাট চত্তরের নাম মার্টিন প্লেস। আমাদের যেমন টিএসসি, নিউইয়র্কে যেমন টাইম স্কয়ার, তেমনি সিডনীর মার্টিন প্লেস। একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সকল আনন্দ আয়োজনে সিডোনীবাসীরা এই মার্টিন প্লেসকে সাজায় অনিন্দ্যরূপে। সেই মার্টিন প্লেসের সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। হারুন মনিশ নামে এক বন্ধুকধারী মার্টিন প্লেসের লিন্ডা চকোলেটে ক্যাফেতে জিম্মি করেছে কাস্টমার ও ওই ক্যাফের স্টাফদের। বন্দুক ধরে সে ওই ক্যাফের ম্যানেজারকে ০০০ নাম্বারে কল করতে বলেছে। ০০০ হলো অস্ট্রেলিয়ার পুলিশের নাম্বার। পুলিশকে কল দিয়ে বলেছে, সে আইএস-এর পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আক্রমণ করেছে। ইতোমধ্যে সে এক ব্যারিস্টার ক্যাটরিনা আর ক্যাফের ম্যানেজার জনসনকে মেরে ফেলেছে। এ নিয়ে সারা অস্ট্রেলিয়ায় তোলপাড়। প্রতিটা মানুষের চোখে আতঙ্ক।

১৫ ডিসেম্বর সকালে শুরু এই হামলা। সারা দিন এই খবর টেলিভশনে লাইভ দেখাতে থাকে। মানুষ টেলিভিশনে শুনছে সেই জিম্মিকারী হারুনের কণ্ঠ। সে পুলিশকে বলছে, ‘প্রধানমন্ত্রী টনি এবোটকে এখানে আসতে বলো। আমি তাঁর সাথে নেগোসিয়াশান করতে চাই’। পুলিশ চেষ্টা করছে নানাভাবে। পুরো ১৬ ঘণ্টা সারা অস্ট্রেলীয়বাসীকে আতংকে ছিল। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২ টার সময় পুলিশের অভিযানে মারা যায় সেই সন্ত্রাসী।

এই ঘটনা ১৫-১৬ ডিসেম্বর ২০১৪। তাঁর থেকে দুই মাসেরও কম সময়ে অস্ট্রেলিয়ায়ই অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে উদবোধন হয় এগারোতম ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বাংলাদেশ তাতে অংশ নিয়েছে। বীরত্বের সাথে খেলেছে। একবারও আমরা বলিনি – সিডনীতে দুই মাস আগে সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে। ওখানে আমাদের নিরাপতার অভাব আছে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সিইও জেমস সাদারল্যান্ডের মত আমরা বলিনি, আগে কেউ গিয়ে নিরাপত্তা রিপোর্ট দিক। তারপর ভেবে দেখব।

আজ বাংলাদেশে না আসার ছুঁতা খুঁজতে ওরা নিরাপত্তার কথা বলেছে। হঠাৎ এত্তো ভীতু হয়ে গেল সেই আগ্রাসী ব্রেট লির অস্ট্রেলিয়া, সেই ঘুর্ণির আতঙ্ক শেন ওয়ার্নের অস্ট্রেলিয়া?
বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। হুম, আমাদের অনেক সমস্যা আছে, সেসব লিখলে রাত শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ মার্টিন প্লেসে আক্রমনের মত কোন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। তাই ভয় পাওয়ার বিষয়টা বিশ্বাস হয় না।

আমি দুটা বছর অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করেছি। ক্যানবেরার মানুকা ক্রিকেট মাঠে খেলেছিও। দুই বছরে আমার একবারও মনে হয়নি জাতি হিসেবে অস্ট্রেলীয়রা ভীরু। সব সময় মনে হয়েছে ওরা লড়াকু জাতি। ব্রিটিশরা যাদেরকে চোর অপবাদ দিয়ে প্রশান্ত সাগরের পাড়ে নির্বাসন দিয়েছে, যেসব রাজনৈতিক বন্দীদের চালান করেছে দূর দ্বীপে, সেইসব মানুষই গড়ে তুলেছে আজকের সুন্দর অস্ট্রেলিয়া। সেই সব অপরাধীরাই তৈরি করেছে মেলবোর্ণের মত শহর, যেটি রযাং মকিং-এ Most Livable City in the World. তাই অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস মানুষের বিজয়ের ইতিহাস। মানুষের পরাজিত না হবার দর্শন। তাতে ভীরুরার কোন স্থান নেই। আমি এমনটাই ভাবতাম। এখন হয়তো আমাকে সেই ভাবনা পালটাতে হলো।

নিশ্চয়ই কোন জায়গা থেকে ক্যাঙ্গারুর চোখে মিথ্যা আলো ফেলা হয়েছে। সেই আলোতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে খেয়ে গেছে অস্ট্রেলীয় জাতি। না হলে, বাংলাদেশে আসতে ভয় পাবার কোন নেই। ক্রিকেট আধুনিক বাংলাদেশের অনেকটা একমাত্র আনন্দের মোহনা। এই আনন্দে বাধা দেবার মানুষ বাংলাদেশে নেই। তাই মিথ্যা জুজু দূর করো। সেই সাহসী অস্ট্রেলিয়াকেই দেখতে চাই।ভীরু অস্ট্রেলিয়ায়কে নয়। প্রমাণ করুন – আপনারা ক্যাঙ্গারুর মত হঠাৎ মিথ্যা আলোতে ভয় পান না।

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ঢাকা, © সুজন দেবনাথ