Select Page

সিলেটের সন্ধ্যা। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছোট্ট একটা টিলার উপরে একা বসে আছি। এই টিলাগুলো আমার একলা বিকেলের কথা-বন্ধু। আমার -মনখারাপের টনিক। আনন্দের কথা সবাইকে বলা যায়। কিন্তু দুঃখের কথা বলার জন্য প্রকৃতির চেয়ে ভাল বন্ধু মানুষের নেই।

তো সেদিন মন একটু বেশীই খারাপ। তবে সেটা রোমান্সঘটিত বিষয়ে নয়। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার আমার তখনও শুরু হয় নি। তখনো আমি ফার্মের মুরগী টাইপের ছেলে – তবে গ্রামের ফার্মের। প্রেম আসি আসি করে, সাহস হয় না। যাই হোক, আমার ঐ দিনের মন খারাপের কারণ এসব কিছুই না। আমার খুব কাছের তিনজন সহপাঠী অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে পড়াশুনা করতে। তাই আমার মন খারাপ। না, বন্ধু বিচ্ছেদের জন্য নয়। আসল কারণ – ঈর্ষা। এক্ষেত্রে ঈর্ষাটার ইংরেজি পজিটিভ শব্দ এমবিশান। যে বন্ধুরা বিদেশ গেল, ওরা আমার চেয়ে পেছনে ছিল। এখন ওরা বিদেশে পড়াশুনা করবে, ভাল ইঞ্জিনিয়ার হবে, টাকা-পয়সা, সুনাম সব হাতে নিয়ে আকাশে চাঁদ হয়ে যাবে। আর আমি!

আমিও তো আকাশ ছুঁতে চাই। আকাশ ছোঁয়ার আশা নিয়েই কম্পিউটার পড়তে সিলেটে এসেছি। কিন্তু আকাশ যে আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। বন্ধুরা আকাশ ছুঁতে বিদেশের রাস্তা ধরেছে। সিনিয়ররা বলছে এই দেশে ইঞ্জিনিয়ারদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। যে বেতন, তাতে হাত খরচই চলবে না। বউয়ের শাড়ি কিনতে পারবা, কিন্তু শাড়ির সাথে ম্যাচ করে অর্নামেন্টস কিনতে তিনমাস বসে থাকতে হবে। তার উপরে সেশনজট। বাংলাদেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটি – পড়াশুনা শেষ হবে তো? আর এদেশে মামা ছাড়া কেউ ভাল চাকরি পায়? সেদিন টিলার উপরে উঁচুতে দাঁড়িয়েও মনে হচ্ছিল আমি পৃথিবীর সবার চেয়ে নিচে। আমার কাছে জীবনের জন্য ভাল কোন স্বপ্ন নেই।

কিন্তু আকাশ তো আমাকে ছুঁতেই হবে – আজই, এক্ষুণি, একলাফে!

এরকম ভাবনা নিয়ে সেদিন টিলার উপর দাঁড়িয়ে জীবনের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললাম। আমিও তখুনি অস্ট্রেলিয়া চলে যাব। যেভাবেই হোক। বন্ধুরা পারলে আমি কেন নয়? এর উত্তর ছিল খুব সহজ – নিজের টাকায় বিদেশে পড়ার মত সামর্থ্য ওদের বাবার ছিল, আমার বাবার ছিল না। কিন্তু এমবিশান আমাকে এসব ভুলিয়ে দিয়েছিল।

মজার বিষয় হচ্ছে, আমার বাবাও বিষয়টা নিয়ে আমার মতই নেচে উঠলেন। আসলে ছোটবেলা থেকে তখন পর্যন্ত বাবাকে কখনও হতাশ করিনি। তাই বাবা ভাবলেন, ছেলে যখন বলেছে, নিশ্চয়ই ভেবে বলেছে। তাঁর বন্ধুরাও বললেন, ‘অনেক ভাল কথা, পাঠিয়ে দাও।’

আমি আইইএলটিএস দিলাম, ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করলাম, এডমিশানের অফারও চলে আসল কয়েকটা ইউনিভার্সিটি থেকে।

আর এসবের জন্য ঢাকা-সিলেট দৌড়াতে দৌড়াতে আমার পড়াশুনা প্রায় থেমে যায় আর কি। আর পড়াশুনা করেই বা কী হবে। এখানে তো আর আমি বেশীদিন নেই। মাঝে মাঝে ক্লাশে যাই, ফান করি, যেন একটা শোডাউন। বন্ধুরা এ নিয়ে ঈর্ষার চোখে আমার দিকে তাকায়। আমার বেশ ভাল লাগে। হুম আমি আকাশ ছুঁতে যাচ্ছি।

আমার বাবাও গ্রামে তাঁর বন্ধুদেরকে একথা বলে আনন্দ পান। ছেলে উন্নত দেশে পড়তে যাচ্ছে – অনেক গর্বের কথা।

সব তড়তড় করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এবার ভিসা। কিন্তু ভিসার জন্য নাকি প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা বাবার একাউন্টে দেখাতে হবে। আবার সেই টাকার উৎস হিসেবে কয়েক বছরের আয়করের বিবরণ দেখাতে হবে। বলে কি? এতো অসম্ভব।

কিন্তু অনেকদূর তো চলে এসেছি। এখন তো ফেরা যাবে না। শুনলাম – কোন ব্যাপার না, এজেন্সিগুলোই সব ব্যবস্থা করে দেয়। গেলাম কয়েকটা এজেন্সিতে। তাঁদের প্রস্তাব হল, তাঁরা ভুয়া সবকিছু তৈরি করে দেবে, ভিসা পেলে তাঁদেরকে পয়সা দিতে হবে, না পেলে নাই। কিন্তু এসব ভূয়ামি করতে মন সায় দিল না। বাবাও নিষেধ করল। তো করব কি?

একটা কাজ করা যায়, কোন ধনী আত্মীয় বা বন্ধু যদি পেপারে সাইন করে তবে সম্ভব। বাবা আর আমি ছুটতে শুরু করলাম ধনী আত্মীয়, বন্ধুদের পিছনে। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা – নিজেকে অত ছোট জীবনে কখনও মনে হয় নি, একেবারে ভিখারি অবস্থা। দু’এক জায়গায় গিয়েই বুঝলাম – টাকার ঘ্রাণ আত্মীয়তা বোঝে না, টাকা অন্য জিনিস। বাবাকে বললাম, ‘বাবা বাদ দাও।’ বাবা বাদ দিবেন না। ছেলের স্বপ্ন পূরণে মানুষের কাছে ছোট হতে তাঁর আপত্তি নেই। আমি অনেক বলেও তাঁকে থামাতে পারলাম না। এক এক দিন একেক জায়গায় বাবা চেষ্টা করেন, আর আমার অপরাধবোধ একটু একটু করে বাড়ে। নিজের জন্য খারাপ লাগাটা লুকিয়ে ফেলতাম। কিন্তু বাবার কথা মনে হলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসত। কিন্তু তখন আমি চেষ্টা করেও বাবাকে থামাতে পারছি না।

এমন সময় একদিন আমার কলেজের এক প্রিয় শিক্ষক ব্যাপারটা শুনলেন। নিজেই ডেকে আমাকে বললেন, তিনি টাকা দেখিয়ে দেবেন, কোন চিন্তা নেই। যাক এখনো পৃথিবীতে দু’একজন ভাল মানুষ আছেন। নিশ্চিন্ত মনে অন্য সব রেডি করে মাস খানেক পর স্যারের কাছে গেলাম। তিনি যা বললেন, আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, “দেখ ভাই, বিষয়টা আমার স্ত্রী জানতে পেরেছেন। উনি ভয় পেয়েছেন। মানুষ জেনে যাবে যে আমাদের অনেক টাকা আছে। আর এদেশে টাকার কথা জেনে গেলে অনেক সমস্যা হতে পারে। তাই উনি কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না। সরি ভাই। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারলাম না।”

এই কয়মাসে আমি অনেক বড় হয়ে উঠেছিলাম। তবুও এইটা যে ঘটবে, তা স্বপ্নেও ভানি নি।

কী আর করা – আমার চেষ্টা এখানেই শেষ।

কিন্তু এবারও বাবা থামলেন না। আসলে তিনি এতদিনও থেমে ছিলেন না। অনেক চেষ্টায় তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমে টাকা ম্যানেজ করে ফেলেছেন। আর সেটা দিয়েই ভিসার এপ্লাই করলাম। আমি জানতাম, ভিসা দিবে না। কারণ টাকা দেখাচ্ছি, কিন্তু ইনকাম সোর্স নেই। আর আমি কোন ভুয়া ডকুমেন্টস জমা দেইনি। যথারীতি ভিসা পেলাম না। এতদিনের পরিশ্রম, আশা সব জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন। আমি সিলেটে ফিরে গেলাম।

ততদিনে ইউনিভার্সিটিতে একটা সেমিস্টার প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আমি কোন পরীক্ষা দেই নি। শিক্ষকরা ভালবাসতেন। তাঁরা ল্যাব এক্সামগুলো নিয়ে নিলেন। কয়েকটা থিউরি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে, সেগুলো আর ওই সেমিস্টারে দিতেই পারলাম না। এই হল পড়ালেখার অবস্থা।

আর বন্ধুরা? এতদিন আমি ভাব নিয়েছি, বন্ধুরা দেখেছে। এখন তো কিছু ফিরিয়ে দিবেই– “কিরে ব্যাটা – অসময়ে উড়তে চাইছিলি, এখন তো পাংখ্যা ভাইংঙ্গা গেল। বেশি ফরফর করন ভাল না।” বাড়িতেও একই অবস্থা। আশেপাশের লোকজন ঠারেঠুরে কথা শুনায়। আমি বাড়ি যাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিলাম। পরের দেড় বছর কতটা মানসিক যন্ত্রণা আর পড়াশুনার চাপ নিয়ে দিন কেটেছে, কিভাবে সিলেট থেকে পড়া শেষ করে এসেছি, ভাবলে আজও শিউরে উঠি।

তারপর সুরমা নদীতে অনেক জল বয়ে গেছে। ঢাকায় ফিরে জিআরই (GRE) দিয়েছি, চাকরি করেছি, আইবিএ তে পড়েছি। এর মাঝেই সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছি। জীবন আসলেই রবি ঠাকুরের ‘বহতা নদী’ – কোন কিছুতেই থামে না। এর কিছুদিন পর অস্ট্রেলিয়ায় পড়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। এবার অস্ট্রেলিয়ার সরকারই সকল খরচ দিবে। চিঠিটা হাতে পেয়েই বাবাকে ফোন দিলাম। বাবা আবেগ প্রকাশ করেন না। শুধু শুনলাম, বাবা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। আমি চোখ বুজে দেখতে চাইলাম – ঈশ্বরের সাথে বাবার সেই মুহূর্তের কথা-বার্তার দৃশ্য।

সিডনি এয়ারপোর্টে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা দিয়েই আমার মনে পড়ছিল সেই সব দিনের কথা, টাকা জোগাড় করতে বাবার সেই প্রাণান্ত চেষ্টার কথা। জীবন – ‘বহতা নদী’ : ভাঙে-গড়ে অথবা শুধুই ভাঙে।

সেই সময় আমার ভুলগুলো ছিল এমন -আমি জেনেছিলাম,কম্পিউটার পাশ করে দেশে ভাল চাকরি পাব না। এটি মোটেও সত্য নয়। এখন আমার বেশীরভাগ বন্ধু সফটওয়্যার কোম্পানীতে কাজ করে আমার থেকে দশগুণ বেশি বেতন পায় – দেশে থেকেও, বিদেশে গিয়েও।ভেবেছিলাম – ঐ মুহূর্তে বিদেশ গেলেই আমি সোনার হরিন পাব। সত্য হচ্ছে – টাকার ব্যাকআপ না থাকলে গ্রাজুয়েশন করতে বিদেশ গেলে অনেকে গ্রাজুয়েশনই শেষ করতে পারে না। পড়াশুনার জন্য গ্রাজুয়েশনের পরই বিদেশ যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ, স্কলারশিপও তখনই বেশি।শুনেছিলাম – দেশে মামা ছাড়া চাকরি হয় না। কয়েকটা চাকরি করেছি, কিন্তু আমার অমন অভিজ্ঞতা হয়নি। সর্বোপরি, আমি এক লাফেই আকাশ ছুঁতে চেয়েছিলাম। শর্টকাট খুঁজছিলাম। কিন্তু Success has no shortcut.

আজ বুঝি – ওই ভুল সিদ্ধান্তটার আসল কারণ অন্য বন্ধুদের চলে যাওয়া দেখে আমাকেও যেতে হবে, এমন ভাবনা – তা নয়। ঐটা ছিল প্রভাবক। আসল কথা হল – সে সময় আমার কোন আশ্রয় ছিল না। হতাশা থেকে মুক্তির উপায় ছিল না। ঐ মুহূর্তে বন্ধুদের বিদেশ যেতে দেখে ঐটাকেই মনে হয়েছিল মুক্তির একটা সহজ পথ। আর এরকম হতাশা আমাদের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীর জীবনেই আসে, আসতে বাধ্য হয়। পাবলিক ভার্সিটির সেশানযট, আর ক্যারিয়ার সম্পর্কে নেগেটিভ কথা শুনতে শুনতে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীরই মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা হয়। আর এসব দেখার জন্য আমাদের ভার্সিটিগুলোতে কতটুকু কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা আছে, সেকথা তো আমরা জানিই।

যাই হোক, এরকম গল্প হয়তো আমাদের অনেকের জীবনেই আছে। কিন্তু ওই অভিজ্ঞতা থেকে আমি যেটা বুঝেছি – একলাফে আকাশ ছোঁয়া যায় না, জীবনের সমীকরণটা সিঁড়িভাঙ্গা সরল অংকের মত। নাম সরল অংক কিন্তু আসলে অনেক জটিল, ধাপে ধাপে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে ফলাফল শূন্যও হতে পারে। তাই ফলাফল নয় – এই পথটাকে, এই চলাটাকেই ভালোবাসি। তাতে যদি সুখ আসে – সেটাই সাফল্য। Success is a journey, not a destination. পথের দেবতা যেমন নিশ্চিন্দপুরের অপুকে বলেছিল, ‘মূর্খ বালক, পথ তো তোমার শেষ হয়নি …… চল, এগিয়ে যাই।’

***