Select Page

সিগারেট মত স্মার্ট জিনিসটাতে আমার একটা ভয়মাখা শ্রদ্ধা আছে।

খুব ছোট বেলায় কাকা একবার আমাকে স্মার্ট বানানোর চেষ্টা করেছিল। পানের বরজের আড়ালে মুখে একটা ক্যাপস্ট্যান সিগারেট দিয়ে বললেন, দে টান। কিন্তু ওই বেরসিক কাশি। দাদুর হাতে কাকা ভীষণ মার খেয়েছিল। সেই থেকেই সিগারেটের প্রতি আমার ভয়।

একটু বড় হলাম। সিনেমায় উত্তম কুমার সিগারেট ধরাচ্ছে। মুখ হা হয়ে যাওয়া বিস্ময়। স্মার্ট শব্দের বাংলাটা তখন থেকেই খুঁজছি। শিল্পের উপর শিল্প। পকেট হতে বের করা থেকে শুরু করে লাইটার জ্বালানো, সুখটান-দুখটান শেষে কুণ্ডলী করে ধুঁয়া ছাড়া। আহা, রবিবাবু দেখলে বলত – নয়ন জুড়িয়ে গেল।

কিন্তু আমার কী হবে! সব মেয়েদের বড় ভাই হলেই চলবে! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একচোখ ছোট করে, ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তম কুমার হতে প্রাণান্ত চেষ্টা করলাম। আয়না বলল, মন্টু পাগলার টানের সাথে কোন পার্থক্য নেই। সাথে ফ্রি কাশি তো আছেই। বুঝলাম আমার দ্বারা ওটা হবার নয়। সেই থেকে সিগারেটের প্রতি আমার একটা সমীহ। অক্ষমের যন্ত্রণামাখা একটা শ্রদ্ধা। অন্যের বউয়ের মত।

এই তামাককে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্রিটেনের সমাজে প্রথম নিয়ে আসেন স্যার ওয়াল্টার র‍্যালে। ইংল্যান্ডের রেনেসাঁ যুগের এই প্রবল ব্যক্তিত্ব এমনিতেই ঝলমলে পোশাক পরতেন। এর সাথে যুক্ত হল নতুন চমক – মুখে একটা সুদৃশ্য পাইপ। মাঝে মাঝে উড়ছে অহংকারী ধুঁয়া। এমন অভিনব দৃশ্য দেখার জন্য রাস্তায় ভীড় জমে গেল। শোনা যায়, সেদিন প্রথম র‍্যালে বাসায় বসে পাইপ টানছেন। একটু একটু ধুঁয়া বের হচ্ছে। তাঁর গৃহকর্মী ভাবল আগুন লেগেছে। পেছন থেকে এক বালতি পানি ঢেলে দিল তাঁর মাথায়। আর আগুন আগুন বলে শুরু করল চিৎকার। এভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বের সহচর হয়ে সেই সমাজে তামাকের প্রচলন।

এই ওয়াল্টার র‍্যালে ছিলেন আবার রাণী প্রথম এলিজাবেথের বিশেষ প্রণয়ীদের একজন। একদিন রাণীর সাথে বাজি ধরলেন। ধুঁয়ার ওজন মেপে দেখাবেন র‍্যালে। রাণীও প্রস্তুত। র‍্যালে রাণীর সামনে ওজন করলেন কিছু তামাক। এরপর পাইপে সেই তামাক টানতে শুরু করলেন। ধুঁয়া উড়ে যাচ্ছে। রানী ভাবলেন, তিনি তো বাজিতে জিতেই যাচ্ছেন। র‍্যালে তো ধুঁয়া মাপার চেষ্টাই করছেন না। তামাক শেষ হলে ছাইগুলিকে ওজন করে র‍্যালে বললেন, দুই ওজনের পার্থক্যই হল ধুঁয়ার ওজন।

র‍্যালের বুদ্ধিতে সদাঅভিভূত রাণী হাসলেন, ‘মানুষ টাকা পুড়িয়ে ধুঁয়া উড়ায়, আর তুমি ধুঁয়া উড়িয়ে টাকা পেলে।’

পরবর্তী কবি, সাহিত্যিকরাও তামাক-সিগারেটের জনপ্রিয়তার জন্য ব্যাপক কাজ করে গেছেন। অস্কার ওয়াইল্ডের নাটক, উপন্যাসে অভিজাত চরিত্রগুলো ছিল তাঁর নিজের মতই তামাকপ্রেমী। ওয়াইন্ড তাঁর ক্লাসিক ‘দি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে’-তে লর্ড হ্যারির মুখ দিয়ে ডোরিয়ানকে বলছেন, “A cigarette is the perfect type of a perfect pleasure. It is exquisite.” আহা, সিগারেট পেলে আর কিছুই চান না অস্কার ওয়াইল্ড।

এই ক্লাসিক চরিত্রগুলোর চেয়ে তামাক বিষয়ে গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর স্কেল আরও উপরে। যেন গোয়েন্দাদের মাথায় আগুন জ্বালাতে তামাকে তামাকে ঘর্ষণ অপরিহার্য। সে আর্থার কোনান দয়েলের শার্লক হোমসই হোক, আর সত্যজিতের ফেলুদাই হোক।

শুধু কবি, সাহত্যিক, গোয়েন্দারাই নয়; রাজনীতি আর কূটনীতিতেও এই তামাক, আফিম অনেক কার্যকর। একথা চীনারা কখনো ভুলবে না। নেপোলিয়ন চীন সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ঘুমন্ত ড্রাগনটাকে ঘুমাতে দাও।’ বিপুল জনগোষ্ঠীর এই জাতি জেগে ওঠলে ইউরোপীয়দের কর্তৃত্বে আঘাত আসবেই। ব্রিটিশরা কথাটাকে খুবই পছন্দ করেছিল। চীনাদের ঘুমিয়ে রাখতে চালান দিল আফিম। অনেক দিন আফিমের নেশায় ঝিমিয়ে ছিল চীন। অনেক রক্তের আফিম যুদ্ধ শেষে চীন মুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, একুশ শতকে এসে নেপোলিয়ানের সেই ঘুমন্ত ড্রাগন প্রায় জেগে উঠেছে। আফিমের নেশা কাটিয়ে এশিয়ান শতকের নেতৃত্বের পথেই হাঁটছে চীন।

কিউবান নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর চুরুট প্রেম মানুষের মুখে মুখে। কিউবার হাভানা চুরুটও জগত বিখ্যাত। ক্যাস্ত্রোর জন্য কিউবায় আলাদা ব্রান্ডের চুরুট তৈরি করা হত। নাম ‘কোহিবা’। আর এই চুরুটপ্রীতিই তাঁর জীবনের জন্য হুমকি হয়েছিল বার বার।

নাকের ডগায় ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা সমাজতন্ত্রের কথা বলে বাতাস করবে – এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের সহ্য হতে পারে? আবার সেই পুঁটি-রাষ্ট্রের উদ্যত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো অহংকারী পাইপ টেনে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমেরিকাকে গালগালাজ করে। এটা কি সিআইএর ভাল লাগার কথা? তো টার্গেট সেই চুরুট। চুরুটের ভিতর ছোট্ট বোমা বসানো হোক। চুরুটের সাথে বটুলিন বিষ দেয়া হোক। আর নিশ্চিত করা হোক – সেই বিশেষ চুরুটগুলোই যেন ক্যাস্ত্রোর হাতে পৌঁছে। আমার ঠাকুরমা শুনলে বলত, ‘ক্যাস্ত্রোর চৌদ্দপুরুষ গরীবেরে লাউপাতা বিলাইছে। নাইলে ক্যাস্ত্রোর বেঁচে থাকার কথা না।’ ভাগ্যের খেলায় ক্যাস্ত্রো তো মরলই না উল্টো কিছু দিন পর খুন হয়ে গেল আমেরিকার তখনকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি।

এই প্লেবয় প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে আমার ভীষণ পছন্দ। মেরিলিন মনরোর মত চিরন্তর আবেদনময়ীর স্বপ্নের পুরুষ ছিলেন তিনি। তাঁরা নাকি উড়ে উড়ে ডেটিং করতেন। না, প্রেমের শক্তিতে গজানো পাখা দিয়ে নয়। দুজনে নাকি বিমান ভ্রমনে বের হতেন মাঝে মাঝে। তো এহেন প্রেমিকের জন্য একটা ঈর্ষামাখা শ্রদ্ধা তো থাকবেই।

যাই হোক, থাকুক তাঁদের প্রেম কাহিনী। কথা হল – এই তুমুল প্রেমিক প্রেসিডেন্টও ছিলেন ভীষণ চুরুটপ্রেমী। তাও আবার সেই শত্রু কিউবার চুরুট। শত্রুতার কারণে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিউবার সাথে সকল বাণিজ্য নিষিদ্ধ। মার্কিন নাগরিকরা আর কিউবার পণ্য ব্যবহার করতে পারবে না। ফাইল পৌঁছল প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাছে। তিনি স্বাক্ষর করলেই এটা আইন হয়ে যাবে। তিনি ড্রয়ারে রাখলেন ফাইলটা। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে তলব করলেন, ‘এক্ষুনি যতবেশী সম্ভব কিউবার চুরুট কিনে আনো।’ ঘন্টাখানেকের মধ্যে বারো কার্টুন কিউবার চুরুট পৌঁছল প্রেসিডেন্টের হাতে। প্রেসিডেন্ট হাত বুলালেন চুরুটের উপর। মুখে হাসি। আর সাথে সাথেই সই হয়ে গেল ফাইলও।

কিউবার সাথে সকল সম্পর্ক নিষিদ্ধ হবার প্রজ্ঞাপন পররাষ্ট্র দপ্তর বিদেশে আমেরিকার সকল দূতাবাসে পাঠাল। সাথে কড়া হুকুম – যার কাছে যা কিছু কিউবার জিনিস আছে, ধ্বংস করে ফেল। তো একজন কূটনীতিক হুকুমের উত্তর দিলেন – ‘আমার কাছে কিছু কিউবার চুরুট আছে। আমি কথা দিচ্ছি-আপনাদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আমি একটি একটি করে চুরুট নিজ হাতে পুড়িয়ে ধুঁয়া করব। একটাও বাকি রাখব না। সব পুড়িয়ে ফেলব। তবে ধীরে ধীরে। পররাষ্ট্র দপ্তর চাইলে সেই চুরুট পোড়ানোর মনোরম দৃশ্যের ছবিও পাঠাতে পারব।’

অনেক তো বড় বড় মানুষের কথা হল। আবার নিজের ছোট কথায় ফিরে আসি। ইউনিভার্সিটিতে একদিন শুনলাম – কবীর সুমনের বিখ্যাত ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই’ গানটা নাকি তিনি সিগারেট নিয়ে লিখেছেন। বলে কী! এ গানে মিশে আছে আমার কত একলা বিকেল। আমার কত আকাশ কুসুম। এর প্রতিটা কলিতে আজানা প্রেমিকার জন্য আমার কুঁড়ি ফোটার অর্ঘ্য। সেটা সিগারেটের মত জিনিসের জন্য! হায়, সব ব্যর্থ।

গানে আছে – ‘অগুনতি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে, অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে।’ এলেখা তো সিগারেট নিয়ে হতেই পারে। ভীষণ রাগ হল সুমনের উপর। অনুভূতি নিয়ে চিট করেছেন তিনি।

পরে দেখলাম, সুমন নিজেই এই গুজবের প্রতিবাদ করছেন। গানটা আসলে নির্ভেজাল প্রেমের গানই। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রিয়াকেই চাই। যাক, আমার কুঁড়ি-প্রেমের আকাশ কুসুম সময়গুলো তাহলে একেবারে সিগারেটের জন্য বৃথা যায় নি।

শুনেছি প্রেমের সাথে সিগারেট বেশ মিল। ভালোবাসা নাকি একটা জ্বলন্ত সিগারেট। এর শুরু আগুন দিয়ে। আর শেষ ছাই দিয়ে। আবার একটা ছাইদানিতে লিখা ছিল, সিগারেট একটা আকর্ষক অগ্নিশলাকা যার পেছনে থাকে একজন স্মার্ট-বেকুব।

বলে কী! উত্তম কুমার বেকুব হলে নায়ক আছে নাকি পৃথিবীতে? তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় আনস্মার্ট-বেকুব হওয়াই ভাল। তো স্মার্টদেরকে সমীহ আর আনস্মার্টদেরকে ভালোবাসা।

© সুজন দেবনাথ