রাবার-ঢিলা হাফ-প্যান্টের বয়সটা তখন প্রায় যাই যাই করছে। মাঝে মাঝে ফুলপ্যান্ট পরে গ্রামের স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। নতুন একটা ছেলে আসল স্কুলে। নাম জুয়েল। সুশ্রী, বুদ্ধিমান। প্রথম পরিচয়েই ভাল লাগার মত। কিন্তু একটা সমস্যা। বেশ একটু তোতলামির অভ্যাস ছিল ওর। কথা বুঝতে ধৈর্য্যের স্কেলটা অনেক বাড়াতে হত। দেখা গেল, দু’এক দিনের মধ্যেই জুয়েলের তেমন কোন বন্ধু নেই।
এর কিছু দিন আগে মানুষের জন্মগত সমস্যা নিয়ে বেশ একটা শিক্ষা হয়েছিল আমার। সত্যরঞ্জন নামে একজন বামন (বেঁটে) ছিলেন আমাদের গ্রামে। সে রাস্তায় নামলেই একদল ছেলেপেলে পিছু নিত। সমস্বরে বলত, ‘বাওনপীর – লিলিপুট, বাওনপীর – লিলিপুট ……।’
বাহ, বেশ মজার খেলা। তো একদিন আমিও নেমে গেলাম তাঁদের সাথে। নাচতে নাচতে বলছি, ‘বাওনপীর – লিলিপুট …।’
হঠাৎ কে যেন আমার কানে ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি বাবা। বাবাকে দেখে ছেলেদের দলও চম্পট। প্রায় এক ঘণ্টা কান ধরিয়ে রাখলেন। সাথে প্রতিবন্ধী সম্বন্ধে বাবার যতটুকু জ্ঞান ছিল সব ঢেলে দিলেন। শুধু তাই নয়। বিকেল বেলা সেই বামন সত্য কাকাকে বাড়ি নিয়ে এসে সরি বলালেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করালেন। ওনার সাথে পুরো বিকেল খেলতে বললেন। অচিরেই টের পেলাম – ‘size does not matter’ – কথাটা সত্য। মনুষত্ব জিনিসটা দেহে নয়, মনেই থাকে।
যাই হোক, সত্য কাকার ঘটনা থেকে অন্যের শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল। এটা জুয়েলের ক্ষেত্রে বেশ কাজে লাগল। ওর তোতলামিপূর্ণ কথা শুনতে ধৈর্য্যের ব্যাপারে আমার কোন আপার লিমিট থাকল না। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু একদিন হঠাৎ ওর কথার উত্তরে আমিও তোতলামি করে উত্তর দিয়ে ফেললাম। বিষয়টা এমন শুনাল যে মনে হল আমি ওকে ভ্যাঙাচ্ছি। কাউকে তোতলাতে দেখলে হয়তো অবচেতন ভাবেই কখনও কখনও সেটা চলে আসে।
আমার উত্তরের সাথে সাথেই ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অপমান ঘিরে ধরল ওকে। আর সাথে সাথে লজ্জা ঢেকে দিল আমাকে। বেশ কিছুদিন লেগেছিল ব্যাপারটা স্বাভাবিক হতে।
জুয়েল অবশ্য বেশিদিন ছিল না আমাদের স্কুলে। কমাস পরেই ওরা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। বহু বছর খোঁজ ছিল না। প্রায় পনের বছর পরে জেনেছিলাম, ও মেলবোর্নের একটা ইউনিভার্সিটিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। সময়কে ও বাজাতে পেরেছে। আমার মত হাজারো মানুষ যারা ওর তোতলামিকে ভেঙিয়েছিল, তাঁদের দেখিয়ে দিতে পেরেছে।
ব্রিটেনের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড একজন আমেরিকান ডিভোর্সি লেডি সিম্পসনের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেন ১৯৩৬ সালে। প্রেমের জন্য পুরুষের ত্যাগ স্বীকারের জলন্ত প্রমাণ।
আজও অনেক পুরুষ এই ঘটনা বলে প্রেমিকার সামনে কলার ঝাঁকায়। যাই হোক, প্রেমিক পুরুষ এই লেখার বিষয় না। বিষয় হল- অষ্টম এডওয়ার্ডের পর যিনি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন, সেই ষষ্ঠ জর্জ ছিলেন ভয়াবহ তোতলা। ইংরেজী ‘কে’ ধ্বনিটি তিনি উচ্চারণ করতেই পারতেন না। এ কারনে সিংহাসনে বসতে একেবারেই রাজি ছিলেন না তিনি। বড় ভাইয়ের সিংহাসন ত্যাগের খবর শুনে তাঁর মা মেরির কাছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। রাজা হয়ে কিভাবে কাজ করবেন! তাঁর তো কথা বলতেই সমস্যা। ভাষণ দিবেন কী করে!
এই প্রিন্স একজন অনিচ্ছুক রাজা হয়ে তাঁর সমস্যা দূর করতে সব রকম প্রচেষ্টা করেছেন। যত টোটকা চিকিৎসা আছে সব করেছেন। মুখের ভেতর মার্বেল দিয়ে বসে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সিগারেট খেলে গলার স্বরের উপকার হয় শুনে চেইন স্মোকার হয়ে যান। এর সাথে অস্ট্রেলিয়ান স্পিস থেরাপিস্ট লিওনেল লগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল। এত কিছু করেও লাভ হচ্ছিল না। অনেক কিছু রানীকে দিয়ে বলাতে হচ্ছিল।
জর্জের ভয়কে আরো ভয়াবহ করে তুলতে সিংহাসনে বসার কিছুদিনের মধ্যেই হিটলার ২য় মহাযুদ্ধের তোড়জোড় শুরু করলেন। ১ম মহাযুদ্ধে এবং ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির অপমানের প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। ১৯৩৯ সালে মহাযুদ্ধ শুরু হয়েই গেল। তাই ব্রিটিশ নাগরিক ও সৈনিকদের মনোবল ধরে রাখতে রাজার একটা সরাসরি ভাষণ অত্যন্ত জরুরী।
ততদিনে যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব ঘটে গেছে। রাজার ভাষণ কোটি মানুষ সরাসরি শুনবে। কিন্তু রেকর্ড করে প্রচার করার প্রযুক্তি তখনও বের হয়নি।
ওই দিকে হিটলার আর গোয়েবলসের জার্মান মিডিয়া অহরহ বলে যাচ্ছে, ‘শোন, তোতলা রাজা! এবার তোমাদের আলুভর্তা করব।’
এর জবাব না দিলে ব্রিটিশদের মনোবল আর থাকে না। যুদ্ধ ঘোষণা তো রাজাকে নিজেকেই করতে হয়।
ষষ্ঠ জর্জ সাহস করলেন। এক বন্ধ ঘরে মাইক্রোফোনের সামনে কেবল রাজা আর থেরাপিস্ট লিওনেল লগ। যেন এক বন্ধুর সাথে কথা বলছেন – এমন ভাবে শেষ পর্যন্ত জর্জ করেই ফেললেন ব্রিটিশদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি। রাজা পারলেন। এই পারাটা তাঁকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিল। মহাযুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিলেন। জার্মান বিমান বাহিনী ব্যাকিংহ্যাম প্রাসাদে বোমা ফেলার পরও রাজা পরিবার নিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে যাননি। ব্রিটিশরা বুঝতে পারল – শুধু সাধারণ মানুষ নয়, রাজাও আক্রান্ত। রাজাও লড়ছেন। তাঁদের মনোবল ধরে রাখতে ষষ্ঠ জর্জ অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারলেন।
১৯৪৪ সাল নাগাদ জর্জ তাঁর তোতলামি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠলেন। মজার বিষয় হলো – সমস্যা দূর হবার পরও তিনি ইচ্ছে করেই ‘W’ ধ্বনিটা তোতলিয়ে উচ্চারণ করতেন। না হলে মানুষ নাকি বিশ্বাস করবে না যে, কথাগুলো সত্যিই তাঁদের সেই তোতলা রাজাই বলছে।
ষষ্ঠ জর্জের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা নিয়ে ডেভিড শীল্ডারের কাহিনীতে টম হপার তৈরি করেন সিনেমা – ‘দি কিং’স স্পিস’। সিনেমাটি ২০১০ সালে একাডেমি এওয়ার্ডস (অস্কার) জয় করে।
যাই হোক, ভয়েসের উন্নতি হবে এই আশার চেইন স্মোক করার জন্য রাজার ফুসুফুসের ক্যান্সার হয়। আর তাতেই ১৯৫২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়, সিংহাসনে বসেন তাঁর কন্যা বর্তমান রাণী ২য় এলিজাবেথ। ততদিনে অবশ্য জর্জের যা অর্জন করার ছিল, সেটা তিনি করে ফেলেছিলেন।
রাজা জর্জ আর আমার বন্ধু জুয়েলকে পাশাপাশি রেখে স্যালুট করতে খুব ইচ্ছা করছে। ওরা সময়কে বাজিয়েছেন নিজেকেই ভেঙে ভেঙে। ঈশ্বরের পরীক্ষাকে তুড়ি মেরে জিতেছেন ইচ্ছাশক্তিকে ভেলা বানিয়ে। মানুষের পরাজিত না হবার তত্ত্বকে ওরাই প্রমাণ করছে যুগে যুগে। ওদের কথা মনে হলে স্বপ্নভূক সময়েও বড় আশাবাদী হতে ইচ্ছা করে।
© সুজন দেবনাথ