প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। একটা পনের বছরের কিশোরী। বেণী দুলিয়ে স্কুলে যায়। স্কুলের পথের কচি ঘাসে কচি স্বপ্ন আঁকে। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই তাঁর ঠাকুরমা বলল, ‘ওঠ ছুঁড়ি, তোর বিয়ে’। কিছু না বুঝতেই বিয়েও হয়ে গেল।
ষোল বছরেই তাঁর কোলে এসে গেল একটা পুঁচকে ছেলে। এই ছেলেটিই আমি। আর এই গল্প আমার মায়ের গল্প।
ছোটবেলায় আমি একটু রোগা টিনিটিনে ধরণের ছিলাম। মা মনে করতেন – আমার এই চিকন-চাকন গড়নের জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী। এজন্য প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর ছিল একটা রুটিন কাজ। আমার শুকনা গাল দুইটা দুই হাতে জোরে জোরে টানতেন। এনালাইসিস করতেন – গতকালের থেকে আজ আমার গালে একটু মাংস বেড়েছে কিনা। হতাশ হয়ে বেচারী নিজেকে শাপ-শাপান্ত করতেন – ‘ইস, আগে যদি একটু বুঝতাম। তাইলে কি আর এমুন হইত? আমার পোলাও ঐ বাড়ির কল্লোলের মতই নাদুস নুদুস হইত।’ এটা ছিল আমার ছোটবেলার একেবারে রুটিনমাফিক সান্ধ্য-প্রোগ্রাম।
এই সান্ধ্য-প্রোগ্রামে আমার গাল ব্যথা হয়ে যেত, মায়ের পরীক্ষা তবু শেষ হত না। গালে ব্যথা নিয়ে চেঁচিয়ে পালাতে চাইতাম। কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকালেই টের পেতাম, এতে এমন কিছু মিশে আছে যা ভাষায় প্রকাশ যায় না, শুধু অনুভব করতে হয়। ওই বয়সেও মায়ের ভালোবাসা ঠিকই বুঝতাম। কিন্তু যেটা বুঝতাম না, সেটা হল – আমি চিকন, ভাল কথা। তো এতে মায়ের দোষ কোথায়? আমার জন্য মা কেন নিজেকে নিজে গালি দেয়?
একটু বড় হয়ে বুঝলাম – বাচ্চাকে মোটা তাজা করার যে কর্মসূচী এখনকার মায়েরা নেন, আমার মা সেটা নিতে পারেননি। আমি ছিলাম বাল্য বিবাহিতা মায়ের প্রথম সন্তান। ওই পনের বছর বয়সেই তিনি বাড়ির বড় বউ। শাশুড়ি পঙ্গু। প্রায় পনের জনের বিশাল সংসার। নতুন বউয়ের কতরকম দায়িত্ব। সবার মন জুগিয়ে চলতে হয়। খেতে হয় সবার শেষে। প্রতিদিন এইসব করে চলতে চলতে নিজেই হয়ে যাচ্ছিলেন শুকনা-পাতলা। এর মাঝেই হঠাৎ টের পেলেন – পেটে সন্তান। কি করলে পেটের সন্তান একটু বেশি পুষ্টি পাবে, সে কথা জানার সুযোগ আর সময় কোনটাই ছিল না। ওই সময় সেই গ্রামে স্বাস্থ্যবিদ্যা পৌঁছেনি। কেউই তেমন কিছু জানত না। তাই আমার কিশোরী মা নিজের যত্নও নিতে পারেননি। আর পুষ্টির ছোঁয়া দিয়ে আমাকে বেশ মোটাতাজা করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।
এরপর দিনে দিনে টেলিভিশন, খবরের কাগজ এসব জিনিস গ্রামের দিকে আসতে শুরু করল। মায়ের স্বাস্থ্য জ্ঞানও বাড়তে লাগল গুনোত্তর হারে। এখন তিনি টেলিভিশনে দেখেন – কি করে সন্তান লালন-পালন করতে হয়। খবরের কাগজে পড়েন – কি করলে শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এসব দেখেন আর নিজের ছেলের দিকে তাকান – ‘হায় হায়, আমি তো এসব কিছুই করিনি। সেজন্যেই তো আমার ছেলে এমন টিনটিন করছে। এই বয়সেই চশমা নিতে হইছে।’
বিষয়টা বোঝামাত্র শুরু হল ভয়াবহ আক্ষেপ । এই আক্ষেপ নিয়েই যদি মা বসে থাকতেন, তাইলে আমার কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু অপরিণত মাতৃত্বের অজ্ঞতাকে পরিণত মাতৃত্বের জ্ঞান-প্রলেপ দিতে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। পারলে ঘি, দুধ, ডিম, মাংস থেকে ভিটামিন আর প্রোটিনের মধ্যে আমাকে ডুবিয়ে রাখেন।
অত্যাচারের উপর অত্যাচার। কিন্তু সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের …। তাই আমার শরীরের দিকে চেয়ে মায়ের করুণ দৃষ্টি আর ঘুচল না। হয়তো মায়েদের এই দৃষ্টি কোনকালেই ঘোচে না। যাই হোক, আমি বেড়ে উঠলাম, বাড়ি ছেড়ে পড়াশুনা করতে ঢাকায় গেলাম। কী করে যেন একটু মোটাতাজাও হয়ে গেলাম। মায়ের স্নেহের অত্যাচার নেই বলে, নিজেই মনে হয় বেশি বেশি খেতাম। কিন্তু মোটা হলে কী হবে? মায়ের ব্যবহারের কোনই পরিবর্তন হল না। একই অত্যাচার চলছিল। সবচেয়ে বিপদ হত ছুটিতে বাড়ি গেলে। আমার ছোট ছোট দুইটা বোনকে সামনে রেখে মাছের মাথা, দুধের সর, ননী খেতে আমি তেমন লজ্জা পেতাম না, কিন্তু আমার জিব বেচারা নড়তে চাইত না। পাজি বোন দুইটাও সামনে বসে আমাকে পিন দিয়ে দিয়ে হাসত। জ্বলুনি নিয়ে খাওয়া শেষ করতাম।
আজ অনেকদিন হল – আমার উপর সেই অত্যাচার হয় না। প্রবাসে আছি গত দুই বছর ধরে। অস্ট্রেলিয়ার মোটা মোটা গরুর সস্তা দুধ খেয়ে অনেক মোটা হয়ে গেছি। আমার ওজন যেভাবে বাড়ছে, তাতে পৃথিবী জানি কবে থেমে গিয়ে বলে ওঠে – তোমাকে নিয়ে আর ঘুরতে পারছি না বাপু, একটু জিরিয়ে নেই। আবার ভুঁড়িটা এভারেস্ট ছোঁয়ার আগে দেশে ফিরতে পারব কিনা – মাঝে মাঝে ভাবি।
মা, তুমি যেটা নিয়ে আক্ষেপ করতে, সেটা দূর হয়েছে। যে দুধের ননী তুমি আমাকে ছোটবেলায় খাওয়াও নাই বলে তোমার এত কষ্ট, সেই দুধ বিদেশে অনেক খেয়েছি। তুমি যা খাওয়াতে চেয়েছিলে, এখানে তা সবই আছে। কিন্তু শুধু সেই মা, মা গন্ধটা নেই। খেয়ে উঠে মুখ মোছার সেই আঁচলটা নেই। ‘ মাগো, কলার মোচার তরকারিটা আর একটু দিবা?’ – তৃপ্তির ঢেকুর নিয়ে একথা বলার কেউ নেই।
এই সেদিনও ইলিশ মাছের ডিমটা তুমি চুপিচুপি তুলে দিতে আমার মুখে। মুখে মাছের ডিম, কিন্তু আমার লালায় মিশতে থাকত বিন্দু বিন্দু মা, আমার প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ত একটা মা-মা পরশ, আমার স্বরতন্ত্রে নীরবে উঠত একটা মা-মা শব্দ। আজ এখানে অনেক মাছ, অনেক মাছের ডিম। কিন্তু তাতে মায়ের কণা নেই, সেই ভালোবাসার রেণু নেই, চুঁইয়ে পড়া আদরটুকু নেই। এই নেইয়ের শেষ নেই। আসলে কিছুই নেই। কিন্তু এই নেই নেই সহ্য করার শক্তিও আর আমার নেই। এবার ফিরতে চাই মায়ের কোলে। আজ আমি সত্যিই ভীষণ ক্ষুধার্ত। মা, আমি তোমার হাতে খেতে চাই। আবার পাতে নিতে চাই সেই ভাত – যাতে মায়ের গন্ধ লেগে আছে।
আমার জন্য ‘মা মা গন্ধ মাখা ভাত’ কি রান্না হয়েছে?
রান্না হয়েছে – “মা মা গন্ধ মাখা ভাত”?