আমি তখন একাদশ শ্রেণী, নটরডেম কলেজে পড়ি। বাবার সাথে নদীপথে লঞ্চে ঢাকায় আসা-যাওয়া করি। সে সময় শরীয়তপুর থেকে ঢাকার বাস চালু হয় নি। ছোট ছোট লঞ্চে করে প্রমত্তা পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়েই বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে হয়।
আমার বাবা লঞ্চে ঘুমানোর অসীম ক্ষমতার অধিকারী। লঞ্চ স্টার্ট করে মাত্র দুইশো মিটার না যেতেই বাবার নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। লঞ্চের ইঞ্জিনের সাথে সুর মিলিয়ে ডাকে। এই নাক ডাকা নিয়ে তার কোনরকম কোন অস্বস্তি ছিলো না। যত অস্বস্তি ছিলো আমার।
একদিন লঞ্চের ডেকে বসে আছি। পাশের বিছানায় একটা টুকটুকে মেয়ে। আমারই বয়সী। মাঝে মাঝে মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হচ্ছে। বেশ লাগছে। মাথার মধ্যে হালকা করে ভ্রমর গুনগুন করতে শুরু করেছে। ভাবছি, আহা, এভাবেই বুঝি শুরু হয়! এমন সময় বাবা শুরু করলেন নাক ডাকা। ছি! এই মহা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাবা নাক ডাকার মত এমন একটা গর্হিত কাজ করতে পারলেন? মেয়েটা আমাকে কি ভাবছে? প্রেস্টিজ আর কিচ্ছু থাকলো না। হলো না। বাবাটাকে আর পাল্টানো গেলো না।
আরেকদিন পাশের একটি মেয়েকে ইমপ্রেস করতে হবে। সেজন্য মেয়েটিকে শুনিয়ে বন্ধুকে বললাম, জানিস, লঞ্চে উঠলেই আমি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই। মনে হয় রবীন্দ্রনাথের মতো বজরায় ভাসছি। পদ্মার উপর ভেসে ভেসে কবিতা লিখছি। গুন গুন করে গানে সুর দিচ্ছি।
বন্ধু বিষয়টা বুঝতে পেয়ে মুচকি হেসে বললো, তাই নাকি! একেবারে রবীন্দ্রনাথ!
আমি বললাম, ঠিক তাই। আর একটু জোরের সাথে বললাম, জানিস, রবীন্দ্রনাথ আটলান্টিক মহাসাগরের একটা বাংলা নাম দিয়েছিলেন, অতলান্তিক। এখন আমার ইচ্ছে করছে বজরা নিয়ে সেই অতলান্তিকে চলে যাই।
মেয়েটি আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। তার মানে আমাদের কথা ভালো করেই শুনছে। চাপাবাজি আরেকটু চালাতে পারলেই আমি সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাব, আর মেয়েটি হবে মৃণালিনী। কাদম্বরী দেবী হলেও আপত্তি নেই।
ঠিক সেই সময়ে বাবা শুরু করলেন নাক ডাকা। ছিঃ ছিঃ, যার বাবা এমন করে নাক ডাকে, তার কপালে কি প্রেম আসে?
তবে লঞ্চের কেবিন ভাড়া করলে, এই সমস্যা নেই। কেবিনে শুয়ে বাবা যতই নাক ডাকুক, কোন তরুণীর কাছে আমার প্রেস্টিজ মাটি হবার সম্ভাবনা নেই।
আমাদের শরীয়তপুরের লঞ্চগুলো ছিলো খুবই ছোট। ট্রলারের চেয়ে একটু বড় হলেও হতে পারে। বরিশালের লঞ্চ যদি মেগা লঞ্চ হয়, তাহলে শরীয়তপুরের লঞ্চ মিনি লঞ্চও না, মাইক্রো লঞ্চ বলা যেতে পারে। প্রতি বর্ষায় মোটামুটি রুটিন করে কয়েকখানা মাইক্রো লঞ্চ নদীতে ডুবে যেত, আর সাংবাদিকরা মহাউৎসাহে সাধু ভাষায় লিখতো, ‘গতকল্য প্রমত্তা পদ্মায় আরও একখানা জাহাজের সলিল সমাধি হইয়াছে’।
একবার এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এইসব মাছ ধরার নৌকার সাইজের লঞ্চগুলো ডুবে গেলে বুঝি জাহাজ হয়ে যায়?
সাংবাদিক সাহেব মাদারীপুরের লোক। তিনি মাদারীপুরের ভাষায় বললেন, ভাইডি, বেশী বুইঝো না। আমি কাগজের লোক, ডকুমেন্ট চেক করেই কথা বলি। ডুবে যাওয়া নৌকাটা খাতাপত্রে জাহাজ ক্যাটাগরিতেই রেজিস্ট্রেশন করা আছে। তাই লিখতে গেলে ঐটাকে জাহাজই লিখতে হবে। জাহাজখানার নাম ছিলো এম ভি দুর্বার।
দুর্বার হোক আর অনির্বার হোক, কিছুদিন পর পরই এগুলি রুটিন করে ডুবে যেত। এসব লঞ্চে যাত্রী কেবিন থাকত মাত্র দুই-তিনটা। সেই সাথে দুই বা তিনটা স্টাফ কেবিন। সারেং সাহেবের জন্য সারেং কেবিন। আনসারদের জন্য আনসার কেবিন। লঞ্চের স্টাফরা সুযোগমতো এসব কেবিন ভাড়া দিয়ে দিতো।
তো, সেবার কেবিনেই বাড়ি যাচ্ছি। আমি আর বাবা। কেবিনটায় আলো একেবারেই নেই। একটা মাত্র অতি ছোট্ট টিউব লাইট টিমটিম করছে। এটা মনে হয় আনসার কেবিন। আনসার কেবিনগুলোর ভাড়া একটু কম।
আমি তখন যেখানেই যাই, হাতে থাকত বই। হাতে বই থাকলে একটা পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব আসে। তখন তো আর স্মার্টফোন ছিলো না। আমার মতো গোবেচারা ছেলে বই নিয়েই ভাব নিতো! কেবিনের ঐ অল্প আলোতেই বই খুলে বসলাম।
বাবা বললেন, এই আলোতে বই পড়া যাবে না। এমনিতেই তুমি চশমা পরো, চোখের বারোটা বাজবে – বই বন্ধ।
এই বয়সটাতেই ছেলেরা প্রথম বাবাকে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। বাবাই যেন তার সব কিছুর বাধা। কেন বাবা তাকে সব কিছুতে বাধা দেন? কেন সে যা করতে চায় বাবা সব সময় তার উল্টোটা করতে বলেন? বাবাই তার স্বাধীনতার পথের কাঁটা। তবু মেনে নিতে হয়। আমিও মেনে নিলাম। বই বন্ধ করলাম।
একটু পরে বাবার চোখ বুজে গেলো। ভাবলাম – বাঁচা গেলো। আবার বইটা খুলে বসলাম। মিটমিট করে চোখের একেবারে সামনে নিয়ে বই পড়ছি। হঠাৎ বইটাতে একটা টান। আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। বাবার কুম্ভকর্ণ ঘুম যে এখন ভাঙতে পারে, তা আমি কল্পনাও করিনি। বাবা কিন্তু কিচ্ছু বললেন না। ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট টর্চ বের করলেন। আমার বইয়ের উপর টর্চের আলো ফেলে বললেন, ‘এইবার পড়’। তিনি আলো ধরে আছেন-আমি পড়ছি। কি যন্ত্রণা! যেই লোকটার এতক্ষণে নাক ডাকার কথা, তিনি সেটা না করে আমার বইয়ের উপর টর্চ ধরে বসে আছেন।
আমি বললাম, টর্চটা আমাকে দিয়ে তুমি ঘুমাও।
তিনি দিলেন না। আসলে বাবা জানতেন, একটু পরেই আমি বই খুলে বসব। তাই তিনি আসলে ঘুমাননি। ঘুমানোর ভান করেছিলেন।
তখন বুঝিনি – পৃথিবীর সকল মানুষকেই তার নিজের চেয়ে পিতা অনেক বেশি চিনেন। আমার আমি তো আমার কৈশোর পার হবার পরের আমি। কিন্তু বাবার আমি আমার প্রথম চিৎকারের আমি। প্রথম হাঁটতে শিখার আমি। প্রথম কথা বলার আমি। আমার প্রথম মিথ্যে বলার সাক্ষী তিনি। তিনিই আমার প্রথম ভুল ধরে ফেলা পুলিশ। আমাকে শাস্তি দেয়া প্রথম বিচারক। আমাকে ভালো মানুষ করার প্রথম গুরু। বাবাই আমাদের প্রথম আইডল।
এক সময় আমি আর বাবা দুজনেই ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু আমি তো লঞ্চে ঘুমাতে পারি না। একটু পরে ঘুম ভেঙে গেল। আবার বই বের করলাম।
টর্চের আলোতে পড়ছি। স্টিফেন হকিং-এর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। হকিং সাহেব শুরু করেছেন – A well-known scientist (some say it was Bertrand Russell) once gave a public lecture on astronomy …. বিখ্যাত বিজ্ঞানী লেকচার দিচ্ছেন – পৃথিবী গোল, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। পেছন থেকে এক বৃদ্ধা উঠে বললো, যত্তো সব রাবিশ কথাবার্তা! পৃথিবী তো ফ্লাট – একটা বড় কচ্ছপের পিঠে বসে আছে। বিজ্ঞানী বললো, বেশ তাই সই – তাহলে কচ্ছপটা কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? বৃদ্ধা রাগ করে শাসিয়ে উঠলো, আমার সাথে চালাকি করো না – সবার নিচে তো কচ্ছপটাই আছে – তার নিচে আবার কি আছে?
আমি পড়ছি আর হাসছি। ভাবছি আজ রাতেই পুরো ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বইটা শেষ করে ফেলব – যদি ততক্ষণ টর্চের আলোটা থাকে।
হঠাৎ লঞ্চটা একটু জোরে দুলে ওঠলো। সময়ের সাথে সেই দুলুনি একটু একটু করে বাড়ছে। বাবার ঘুম ভেঙে গেলো। বাবা বুঝতে পারলেন, নদীতে ঝড় উঠছে।
তিনি লাফ দিয়ে কেবিনের দরজা খুলে ফেললেন। আমাকে বললেন, ফুল প্যান্ট খুলে ফেল, শর্টস পড়ে নে।
আমি তাই করলাম।
একটু পর আবার বললেন, জামা খুলে ফেল। লঞ্চ ডুবে গেলে সাঁতার দিতে হবে – গায়ে কিচ্ছু রাখার দরকার নেই – একেবারে হালকা হয়ে নে। কিন্তু আমি দেখলাম, বাবা এখনও ফুল প্যান্ট পরে আছেন – সাথে মাফলারও আছে। আমার গায়ের সব কিছু খুলে আমাকে একেবারে হাল্কা করছেন। কিন্তু নিজে যে সবকিছু পরে আছেন – সেটা তাঁর মনেই নেই।
লঞ্চের দুলুনি আরও বাড়ছে। মাঝে মাঝে একদিকে অনেকটা কাত হয়ে যাচ্ছে। বাবার চোখ উদভ্রান্ত। আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছেন.. আর কি করা যায়, কি করা যায় ? হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে লঞ্চে তো বয়া আছে – বয়া ধরে তো পানিতে ভেসে থাকা যায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সবগুলো বয়া দখল হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার তো লাগবেই – অন্তত একটা বয়ায় আমার জন্য এক ফোঁটা জায়গা তাকে করতেই হবে। বাবা ছুটছেন পাগলের মত। এদিক থেকে ওদিক। আমি কিছুতেই তাকে থামাতে পারছি না। লঞ্চটা একেকদিকে হেলে পড়ছে। তার মধ্যেই বাবা ছুটছেন। কিন্তু প্রতিটা বয়ার চারপাশে অনেক লোক। বাবা সামনে যেতেই পারছেন না।
আমি শুনছি তিনি কাকে যেন বলছেন – ‘ভাই, আমার কিচ্ছু লাগব না, তুমি এই ছেলেটারে বয়াটা একটু ধরতে দিও।’
আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। একটু পরে লঞ্চ ডুবে গেলে আমি মারা যাব – সেটা আমার মনেই হচ্ছিলো না। শুধু কান্না আসছিল বাবাকে দেখে। আমাকে বাঁচাতে – শুধু আমাকেই বাঁচাতে – তিনি নিজেকে তুচ্ছ করে যেভাবে ছুটছেন!
অতি বড় দুঃসময় নাকি হঠাৎ করেই কেটে যায়। সেই রাতের ঝড়টাও যেন একসময় হঠাৎ করেই থেমে গেলো। কিন্তু সেই রাত আমাকে অনেক বড় করে তুললো – আমার বয়স অনেকটা বাড়িয়ে দিলো।
আমি বুঝলাম – আমার কিশোর বয়সের বাবা আমার প্রতিপক্ষ নয়। তিনিই আমার কচি বয়সের আশ্রয়, আমাকে সঠিক লাইনে রাখার কম্পাস। আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আমাকে বাঁচাতে চায়, এমন মানুষ পৃথিবীতে মা-বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার মনে হলো – বাবার নাক ডাকার শব্দের চেয়ে পবিত্র শব্দ আমার জন্য আর নেই।
আমি এখন দেশ বিদেশে ঘুরি। মায়ের সাথেই ফোনে কথা বলি। বাবাকে দরকার ছাড়া ফোনও দেয়া হয় না।
বাবার নাক ডাকার মতো অতো পবিত্র শব্দ আমি কতদিন শুনি না। তবু আমি জানি – আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়টা আমার জন্য তাঁর ছায়া বিছিয়ে বসে আছেন বাংলাদেশের ছোট্ট এক গ্রামে।
আমি অনেক ভাগ্যবান যে – আমার একজন বাবা আছেন।
………………………