সমর বিশেষজ্ঞ বা যুদ্ধ-পণ্ডিতেরা বলেন, মানুষের ইতিহাস নাকি যুদ্ধ, বিরোধ আর অশান্তির ইতিহাস। অশান্তির চক্রব্যূহেই নাকি মানব সভ্যতার আবর্তন। তবে তাঁরা যাই বলুক – এই অশান্তির চক্রব্যূহ ছিন্ন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষের চেষ্টা অনেক দিনের। আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিচুক্তির ইতিহাসই প্রায় ৩২০০ বছরের। খ্রিস্টের জন্মের ১২৫৯ বছর আগের। সেই সময় মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস (Ramesses-II) এবং হিতিতি রাজা তৃতীয় হাতুসিলির মধ্যে হয়েছিল চুক্তি।
ইতিহাসের সবচেয়ে পুরুনো মৈত্রীচুক্তি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাকক্ষের প্রবেশ দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে এই চুক্তির কপি। যেন বিশ্বনেতারা শান্তি আলোচনায় যাবার পথে দেখতে পান, আজ থেকে প্রায় ৩২০০ বছর আগে দুই রাজা শান্তিরক্ষায় চুক্তি করতে পেরেছিল। তাহলে সভ্যতার এই যুগে তাঁরা কেন পারবেন না?
মিশরীয় সভ্যতা তখন সর্বোচ্চ চূড়ায়। সিংহাসনে তখন বিখ্যাত ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস। বিশাল ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েলের অংশ বিশেষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর রাজ্যের পরিধি।
অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে হিতিতিরা শক্তি অর্জন করতে থাকে। তাঁরা মিশরের ফারাওদের কাছ থেকে বর্তমান সিরিয়া, লেবাননের কিছু অংশ ছিনিয়ে নেয়। এই ভুমি দখল আর পাল্টা-দখল নিয়ে ফারাওদের সাথে হিতিতিদের যুদ্ধ ছিল প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে ফারাও রামেসেসের সাথে হিতিতিদের এক বিশাল যুদ্ধ হয়। এতে রামেসেস জয়ী হলেও, হিতিতিরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাঁরা সাধ্যমত চেষ্টা করছিল, হারানো রাজ্য ফিরে পেতে। তাই ছোট ছোট খণ্ডযুদ্ধ লেগে ছিল তার পরের প্রায় ১৫ বছর।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৬৭ সালে হিতিতিদের সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী রাজপুত্রকে হত্যা করে রাজা হন হাতুসিলি। ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করায় রাজা হসেবে তাঁর বৈধতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সবাই তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। এ অবস্থায় প্রতিবেশী রাজারা তাঁকে স্বীকৃতি দিলে তাঁর জন্য রাজা হিসেবে টিকে যাওয়া সহজ হয়। তাই তিনি ফারাওয়ের সাথে শান্তি স্থাপনের একটা উপায় খুঁজছিলেন।
আবার ওই অঞ্চলেই এসিরীয়রা প্রতিষ্ঠা করছিল একটি শক্তিশালী রাজত্ব। তাঁরা যে কোন সময় আক্রমন করতে পারে হিতিতিদের। এই এসিরীয়িদের থেকে একই রকম ভয় ছিল মিশরীয়দেরও। সম্রাট রামেসেসও এসিরীয়দের থেকে ভীত ছিল। তাই রামেসেসও হিতিতিদের সাথে শান্তি চাইলেন। এভাবে দুইপক্ষই একটা উপায় খুঁজছিল সম্মানজনক সন্ধির।
সেই উদ্দেশ্যে হিতিতি রাজা হাতুসিলি একজন দূত পাঠালেন রামেসেসের কাছে। রামেসেস রাজি হলেন। স্বাক্ষরিত হলো চুক্তি। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম মৈত্রীচুক্তি। মিশরীয়-হিতিতি শান্তিচুক্তি। খ্রিস্টের জন্মের ১২৫৯ বছর আগে। আজ থেকে প্রায় ৩২০০ বছর পূর্বে। তখনও পৃথিবীতে কাগজ আসে নি। তাই দুইপক্ষ পাথরের উপর খোদাই করে লিখল সেই চুক্তি।
মিশরের মন্দিরের গায়ে লিখা আছে এই চুক্তির মিশরীয় ভার্সন। আর হিতিতিদের ভার্সন পাওয়া যায় ১৯০৬ সালে মাটি খুঁড়ে হাত্তুসা নগরী আবিষ্কারের পর। এই হাত্তুসা নগরী বর্তমান তুরস্কে। তুরস্ক সরকার জাতিসংঘকে এই চুক্তির কপি দান করে। আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাকক্ষের ঠিক সামনে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে এই চুক্তির কপি। মজার বিষয় হচ্ছে এই চুক্তি যে অঞ্চল নিয়ে সেটি বর্তমান প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল ভূখণ্ড। আজ থেকে ৩২০০ বছর আগে এখানে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। আর এখন সম্ভব হচ্ছে না।
© সুজন দেবনাথ