শুক্রবার সন্ধ্যা। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় এক বন্ধুর ছোট্ট মুদি দোকানে বসে আছি। এখানে এসব ছোট ছোট মুদি দোকানকে বলে কনভেনিয়েন্স সপ। বড় চেইন সপ বা সুপার মলে না গিয়ে টুকিটাকি জিনিস কেনার জন্য এসব দোকান বেশ কনভেনিয়েন্ট।
তখনো সন্ধ্যা তেমন একটা গাঢ় হয়নি। দোকানে টলতে টলতে ঢুকলো এক পাঁড় মাতাল। বয়স ২০-২৫, চোখগুলো টকটকে লাল। দোকানে ঢুকেই এক একটা জিনিস ধরছে আর চোখের খুব কাছে নিয়ে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে। আহা বেচারা, আজকে এখনও মনে হয় কোন গার্লফ্রেন্ড জুটাতে পারেনি। তাই মনের যত জ্বালা, সবটাই সম্ভবত মদের উপরেই ঢেলে দিয়েছে। এতোটাই ঢেলেছে এখন ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না।
সপ্তাহ শেষে শুক্রবার সন্ধ্যা ওদের জন্য উৎসব। নিজেকে জ্বালানো অথবা রিফিল করার উৎসব। এই রাতে যেভাবেই হোক সারা সপ্তাহের ক্লান্তি উজার করতেই হবে। সেজন্য মেয়েরা সেজেগুজে বের হয় বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে আর ছেলেরা তাঁদের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে। সন্ধ্যা বেলাটা সাধারণত নাচ, গানেই কেটে যায়। কিন্তু আজকের এই মাতাল এই ভর সন্ধ্যায়ই আকণ্ঠ নেশা করে এখন বিজ্ঞানীর মতো সব জিনিস পর্যবেক্ষণ করছে।
হঠাৎ একটা কিছু ধরে চিৎকার করে উঠলো – ‘I can’t tolerate this, man. I cannot tolerate. না, না, তুমি এটা বিক্রি করতে পারো না’। দোকনের মালিক আমার বন্ধু দৌড়ে তাঁর কাছে গেলো। কি জিনিস সহ্য করতে পারছে না!
মাতাল সাহেবের হাতে একটা ললিপপ। সেই ললিপপের ভেতর একটা স্করপিয়ন বা বিছার মত একটা প্রাণী। দেখে মনে হচ্ছে – একটা জীবন্ত স্করপিয়নকে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ললিপপের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে।
মাতাল সেটি হাতে নিয়ে চিৎকার করছেন – ‘তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন? তুমি এটা বিক্রি করতে পারো না। এটা একটা জীবন। একটা জীবন্ত প্রাণীকে এভাবে বন্দী করে দোকানে সাজিয়ে রেখেছ। এটা মানুষের করা উচিত নয়। তুমি তো মানুষ, তুমিও একটা প্রাণী। এটা করতে পারো না। আই কান্ট টলারেট, আমি সহ্য করতে পারছি না।’
আরে মাতাল বলছে কি? একটু আগে সে ছিলো বিজ্ঞানী, এখন তো দার্শনিক হয়ে গেছে। জড়ানো গলায় টলতে টলতে একেবারে স্বামী বিবেকানন্দের জীবেপ্রেম টাইপের দর্শন বলছে। ওর চোখে মুখে আসলেই এক ধরনের আকুলতা। মনে হচ্ছে আসলেই সহ্য করতে পারছে না।
আমার বন্ধু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। সে বলছে, মাই ফ্রেন্ড, আমি তোমার চিন্তা বুঝতে পেরেছি, ঠিক আছে। আমি এটা সরিয়ে রাখছি, তুমি শান্ত হও।
মাতালের চিৎকারে আশেপাশের লোক এসে দোকানে মোটামুটি ভিড় হয়ে গেছে। এখন সবাই জীবপ্রেমী হয়ে গেছে। এদের মধ্যে হয়তো একজন গতকাল এই দোকান থেকেই স্করপিয়ন কিনে গার্লফ্রেন্ডকে দেখিয়ে দেখিয়ে মহানন্দে চুষে চুষে খেয়েছে। আর এখন সে বলছে, ‘এগুলো মানুষ খেতে পারে, এগুলো নিশ্চয়ই চীন বা ভিয়েতনাম থেকে এসেছে। ওই সব দেশের মানুষ তো এমন জীবন্ত পোকাই খায়, আমাদের মত সভ্য মানুষ পারে না’।
কৌতুহল নিয়ে আমি একটা প্যাকেট উলটে দেখলাম, ‘মেইড ইন আমেরিকা’। মনে মনে হাসলাম, কিছু বললাম না।
মাতাল এবার আমার বন্ধুর হাত ধরে ফেলেছে – ‘কথা দাও বন্ধু, তুমি এটা আর বিক্রি করবে না। কথা দাও। ক’পয়সা পাও তুমি এটা বিক্রি করে। আমি সেটা এক্ষুণি দিয়ে দিচ্ছি। তাও কথা দাও। আমি এটা সহ্য করতে পারছি না।’
বলতে বলতে সে কিছু ডলার বের করে ফেলেছে – ‘এই নাও, সব তোমার, আমার যা আছে সব তোমার। তবু তুমি এটা বিক্রি করো না। এটা মানবতার অপমান। দেখিয়ে দেখিয়ে জীবন্ত স্করপিয়ন চিবাচ্ছে মানুষ, আমি এটা দেখতে চাই না। ঈশ্বরের সৃষ্টির এমন অধঃপতন দেখতে চাই না’।
আমার বন্ধু অনেক কষ্টে সামাল দিলো। দোকান থেকে বের হবার সময়ও মাতালটা বলে যাচ্ছে, ‘আমি সহ্য করছে পারছি না, এটা মানবতার অপমান, এটা ঈশ্বরের অপমান’।
আমি তাঁর চলে যাওয়া দেখছি। হয়তো সুস্থ অবস্থায় তরুণটা এমন কথা বলতে পারবে না, তাঁর মুখ তখন আটকে যাবে দুনিয়ার আইন কানুন আর নিয়মের আড়ালে। এখন মাতাল অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়ে এসেছে কঠিন সত্য। চমৎকার দর্শন। সে বলতে পারছে – ‘এটা মানবতার অপমান, এটা ঈশ্বরের অপমান’।
এই বোধটুকু আছ বলেই মানুষ অন্যরকম। এরিস্টটল বলেছেন, Man is a Political Animal. তিনি প্রাণী আর রাজনীতি দুটো বিষয়েরই একেবারে প্রথম দিকের গবেষক। তাই তাঁর কথা মানতেই হবে – হুম মানুষ একটা রাজনৈতিক প্রাণী মাত্র, সে স্বার্থের জন্য, ক্ষমতার জন্যই বেঁচে থাকে। তবু সেই সাথে আরও কিছু অনুভূতি আছে, যা মানুষকে অন্যভাবে চিন্তা করতে শিখায়। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য, সবার জন্য পৃথিবীকে আর একটু সুন্দর করতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে বলেই সে মানুষ। মানুষ শুধু রাজনৈতিক প্রাণী নয়, একটি সামাজিক প্রাণীও।
// ক্যানবেরার ললিপপ: মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী, শুধু রাজনৈতিক প্রাণী নয়
// ©সুজন দেবনাথ