একটু থেমে থেমে ভোঁ ভোঁ শব্দ করছি – আর আমার দিকে পিঁপড়ের মত ছুটে আসছে মানুষ। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তো উঠছেই। আমার ডিমান্ড আজ এভারেস্টকে হারিয়ে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে সেজেছি আমি। ধুয়ে-মুছে রঙ লাগিয়ে আমাকে যৌবন ফিরিয়ে দিতে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও কিছু অফিসার আমাকে দেখে খুশি হন নি। আমি নাকি এখন আর চলনসই নই। সার্টিফিকেট পেতে অফিসারদেরকে অনেক কিছু দিতে হয়েছে।
আমার যাত্রা শুরুর সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু মানুষ কেবল আসছেই। ডান দিক দিয়ে কয়েকটি পরিবার রুদ্ধশ্বাসে আসছে। দুজন তরুণ পুলিশ তাঁদেরকে নিষেধ করছে।
‘মরবার লাইগা উঠতে চান! কানায় কানায় ভইরা গেছে। আর কাউরে উঠতে দেয়ন যাইব না।’
মানুষগুলো প্রায় হাতে পায়ে ধরে পুলিশকে অনুনয় করছে – ঈদে তাঁদের বাড়ি যেতেই হবে। একজনের পকেট থেকে কী যেন বের হল। পুলিশ দুটি সেটা নিবে কিনা ভাবছে। আর একজন পুলিশকে হুমকি দিচ্ছে। ‘আমি অমুকের তমুক। আমারে উঠতে দেওনই লাগব।’ দয়া, উৎকোচ না হুমকি কোনটা কাজে এসেছে শুনতে পাইনি। কিন্তু ঐ পরিবারগুলোও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।
আমার মালিকের শ্যালক হাসতে হাসতে ঘাটের নেতাদের সাথে ধুঁয়া ছাড়ছে। সারেং যাত্রা শুরু করার জন্য তাঁর কাছে ইতোমধ্যে নয়বার খবর পাঠিয়ে ফেলেছে। তাতে কাজ না হওয়ায় এখন একটু পর পর আমাকে দিয়ে বিকটভাবে ভোঁ…য়্যোঁ ভোঁ…য়্যোঁ করাচ্ছে। সারেং মনে হয় একটু ভয় পাচ্ছে। মালিকের শালার কোন ভয় নেই। সে আমার সাথে যাবে না।
অবশেষে একসময় মালিকের শালা, সারেং আর ঘাটের নেতা সবার চাওয়া এক হল। বুড়িগঙ্গার বুক কেটে কেটে চলতে শুরু করলাম আমি। সদরঘাট পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। এখন আমার দুপাশে বাতাস লাগছে, শরীরের বাইরেটা শীতল হয়ে যাচ্ছে। তবে ভেতরে বাতাস থাকার জন্য কোন জায়গা নাই। এবছর ঈদ আর পূজা পাশাপাশি পড়েছে। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে। ২৫০ জনকে বইতে পারি আমি। কিন্তু আমার পেটে এখন ৮৫০ জনের মত মানুষ। মনে হচ্ছে মানুষগুলো ভেতরের সব বাতাস খেয়ে ফেলে আমাকেও খেয়ে ফেলতে চাইছে। তাই মাঝে মাঝে একটু ভয় ভয়ও করছে।
আমার সামনের দিকে দোতলার ডান দিকের কেবিনটা ভাড়া করেছিল নতুন বিয়ে হওয়া এক যুগল। শহুরে নবোঢ়া তরুণীর এটাই প্রথম লঞ্চ ভ্রমণ। মনে আশা ছিল, প্রমোদতরীতে হানিমুনের আনন্দ মাখতে মাখতে যাবে। কিন্তু স্বামীর পরিচিত আট-নয় জন মানুষ সেই কেবিনে ঢুকে পড়েছে। বেচারী তরুণী হাসি মুখে সবার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। তাঁর মুখ হাসছে কিন্তু চোখ হাসছে না।
‘ভাবী আপনাদের হানিমুন ট্রিপ মাটি কইরা দিলাম।’
এর উত্তরে তরুণী ‘আরে ভাই না না’ – ধরনের কিছু বলার কথা ছিল। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। সত্য আর লজ্জা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। হানিমুন ট্রিপকে হাসি ঠাট্টা দিয়ে নৈশ পিকনিক বানানোর মত মানসিক শক্তি পাচ্ছে না সে।
আমি মৃদু গতিতে ভেসে চলছি বুড়িগঙ্গা ধরে। কালো পানি কেটে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চাইছি ধলেশ্বরীর ঘোলা পানির দিকে। ধলেশ্বরীতে আর একটু খোলামেলা, সেখানে একটু দ্রুত চলতেও পারব। তখন আর এই ঘরমুখো আনন্দকে নিয়ে চলতে আমার মন্দ লাগবে না।
পুরো ডেকের উপর তিল ধরার জায়গা নেই। ধনী-দরিদ্র, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ যে যেভাবে পেরেছে শুধু কোমরটা ছুঁইয়েছে ডেকের উপর। অনেকে তাও পারেনি। দাঁড়িয়ে আছে কোন এক খুঁটি ধরে।
ডেকের এক কোনা ঘেঁষে এক অসম্ভব সুন্দরী তরুণী বসেছে। পাশে বাবা, বাবার হাতে একটা বইয়ের ব্যাগ। মনে হয় মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে – বাবা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে ঈদ করতে। মেয়েটি কোন রকমে হাঁটু ভাজ করে ক্ষীণ আলোতে একেবারে চোখের সামনে খুলে ধরেছে একটা বই – ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। পাশেই ওই মহা ভীড়ের মধ্যেই তাস নিয়ে বসেছে চারজন যুবক। তাঁদের চোখ তাসের সিকে আর মনোযোগ মেয়েটার দিকে। কিন্তু ক্ষীণ আলোতে মেয়েটা বইটা চোখের এত কাছে নিয়ে পড়ছে যে – তাঁর মুখ কিছুতেই দেখতে পাচ্ছে না তাসারুরা। কিন্তু চেষ্টা করলে চোখকে কোন কিছুতে আটকে রাখা যায়, কানকে যায় না। তাই আর কিছু না পেয়ে এই মুহূর্তে তাসারুদের টার্গেট মেয়েটার কান।
-ট্রাম
-আব্বে হালা, ওভার ট্রাম।
-বসা কালীপদ। মাম্মা, জিনিসরে ভাই এক্কান। তর মায়রে বাপ।
বুড়িগঙ্গার সরু ধারা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আমি এখন দুলে দুলে ধলেশ্বরীর জলে প্রবেশ করছি। দুই নদীর ঠিক মিলনের জায়গাটায় আমাকে একটু লাফ দিতে হল।ঠিক তখন ছাদে দাঁড়িয়ে এক ২৫-১৬ বছরের তরুণ দুরবীনে আকাশে তারা দেখার করছিল। আমি বুড়িগঙ্গা থেকে লাফ দিয়ে ধলেশ্বরীতে আসার কাঁপুনিতে ওই ছেলেটির দূরবীণটি গেল হাত থেকে পড়ে গেল। পড়ল আবার এ ঝিমুতে থাকা বৃদ্ধের মাথায়। বৃদ্ধ প্রথমে ভয় পেয়ে মাগো-বাবাগো ডাক শুরু করেছিল। কিন্তু আসল ঘটনা বুঝতে পেরে তাঁর যৌবন ফিরে আসল। তাঁর বিবেচনায় দূরবীণটাকে নদীতে ফেলে দেয়াই একমাত্র শাস্তি। সে চেচাচ্ছে
‘এই ঘন্টাডারে যুদি পানিতে না ফালাইছি তাইলে আমার নাম চাঁনমিয়া না।’
-সরি চাচা সরি, হঠাৎ দুলে ওঠায় হাত ফসকে গেছে।
-সামলাইতে না পারলে ঘন্টাডা তুমি লইছ কেন? আর ইট্টু হইলেই তো মাঠাডা ফাইটাই যাইত। এইডারে পানিতে ফালাইয়া নদীরে কিছু দান করমু।শোনেন চাচা, এইটা অনেক দামের একটা জিনিস।
-কত দাম?
-তা হবে, আটশ ইউরোর মত। ইতালি থেকে আমার বাবা এনেছে। বাংলাদেশী টাকায় দাম আশি হাজারের কাছাকাছি।
বৃদ্ধ মুখটা হা হয়ে গেছে। কিছু না বলেই দূরবীণটা এগিয়ে দিল ছেলেটির কাছে। সেটা নিতে নিতে ছেলেটি চাচার সামনে বসে পড়ল,
‘চাচা, দেখেন, এইটা দিয়া আকাশটা অনেক সুন্দর দেখা যায়। কত সুন্দর সুন্দর জিনিস আমাদের মাথার উপরে। আজকে কালপুরুষটা একেবারে আপনার জুয়ানকালের চেহারার মত।’
বৃদ্ধের মুখে কথা বন্ধ হয়ে গেছে। সে দূরবীণটা নিবে না। সে না নিলেও নেয়ার জন্য হাত বাড়াল আরেকজন। সাত বছরের বাবন। দূরবীণটা হাতে নিয়ে পাশের বৃদ্ধাকে বলছে,
‘ঠাম্মি দেখ দেখ, সপ্তর্ষিটা কত কাছে। তুমি হাত দিলেই ছুঁতে পারবে। এই দিদি, তুই দেখবি? না দেখিস না। কালপুরুষটাও এত্ত কাছে, তুই ভয় পাবি। তোর যেদিন আমার মত সাহস হবে সেদিন দেখিস।’
তাঁর দিদি মনে হয় আল্ট্রা স্মার্ট বাবনের এই ধরনের অপমানের সাথে পরিচিত। সে কিছু বলল না। তাঁর ঠাম্মা দুরবীণটা হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দূরবিনের মালিককে বলল, ‘শোন ভাই, তোমার বাবা মনে হয় এইটা কিনতে একটু ঠকে গেছে। বসুন্ধরা মার্কেটে এই জিনিস অনেক কম দামেই পাওয়া যায়।’
এবার শব্দ করেই হেসে ওঠল দূরবীণের মালিক।
‘চাচা মিয়া, আমি আপনারে মিথ্যা বলছি। এইটা আসলে ঢাকার থেকেই আট হাজার টাকা দিয়া কিনছি। আর আমার বাবাও ইতালী থাকে না। তবে আমাদের বাড়ির আশে-পাশে অনেকেই ইতালি থাকে। তাই ঐটাই মুখ থেকে সহজে বের হইছে।’
পাশের থেকে সেই বাবন বলে উঠল, ‘তেমন কিছু না, বাইনোকুলারের সামনে একটা গোল্লা এঁকে দেই। আট হাজারের সামনে একটা শুন্য দিলেই আশি হাজার হয়ে যাবে।’
বৃদ্ধের মুখে এতক্ষণে হাসি বের হয়েছে – ‘মাশাল্লা, ছেলে তো জব্বর বুদ্ধিমান। বিচ্ছু পোলাপান কাছে থাকলে দিলডায় আনন্দ লাগে। আহ ভাই, এইহানে আহ। আমারে ইট্টু তারা চিনাও দেখি। দেখাও কোনডা তোমার কালপুরুষ?’
এভাবে আমার ছাদের উপরে তিনটা অচেনা পরিবার মিলে একটা পরিবার হয়ে গেল। আজ রাতে আমার কোলে শুয়ে তাঁরা ছোট্ট সুন্দর একটা পৃথিবী বানাচ্ছে। পৃথিবীতে সকল ঝগড়ার ফলাফলই যদি এমন হত। আহা, ছাদের উপরের এই ঘটনা আমি তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। কখন যে পদ্মায় এসে গেছি টেরই পাইনি। ঢেউ আর বাতাস দুই দিক দিয়ে যখন আমাকে জোরে কাঁপিয়ে দিল, দেখলাম আমি পদ্মার বুকে এসে গেছি। এই সেই প্রমত্তা পদ্মা। অনেক কীর্তিকে নাশ করেছেন বলে কবিরা এর নাম দিয়েছেন কীর্তিনাশা। আমার প্রথম মালিকও একটু কবি কবি ধরনের ছিলেন। পদ্মার বুকে আমাকে আমি চলব, তাই আমার নাম রেখেছিলেন এমভি কীর্তিনাশা। তাঁর বাবা অবশ্য অনেক নিষেধ করেছিলেন। এমন নেগেটিভ নাম রাখলে সেটা নাকি দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে। কবি মালিক এটা শোনেননি। কবিদের চোখে সৌন্দর্য্যই সত্য, দুর্ভাগ্য-সৌভাগ্য বলে কিছু নেই।
তারপর এক যুগের বেশি সময়ে তিনবার মালিক পাল্টেছে। আর প্রথম মালিকের সময়েই ভাল জাহাজ হিসেবে মালিক সমিতিতে আমার একটা ব্রান্ডভ্যলু সৃষ্টি হইছে। তাই কেউ আর আমার নাম পাল্টায়নি। এখন আমি প্রায় বৃদ্ধ। অফিসাররা আমাকে ভাসতে দিতেই চায় না। অনেককে ম্যানেজ করে মালিক আমাকে এখনও চালাচ্ছে। তাই আমার উচিত মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। কিন্তু কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি পদ্মার ঢেউয়ের মুখে একটু একটু ভয়ও লাগছে আজ। এত বিপুল মানুষ আর অনন্ত পদ্মাও যেন আজ একটু বেশিই নাচানাচি করছে।
দোতলায় পেছনের দিকে সারেঙয়ের জন্য একটা আলাদা কেবিন আছে। সেটাও আজ ভাড়া হয়ে গেছে। ভাড়া যে লোক নিয়েছে তাঁর হাতে এখন একটা সিনেমার সচিত্র ম্যাগাজিন আনন্দবানী, পাশে তরুণী শ্যালিকা। ঈদ উদযাপন করতে মেয়েটি বোন-জামাই বাড়ি যাচ্ছে। তাঁর বোন এখনও জানে যে, রাতের লঞ্চে তাঁরা ভিড়ের মধ্যে ডেকের এক কোনে বসে আছে। কিন্তু তাঁর দুলাভাই মানুষটা অনেক ভাল। এত ভিড়ে কারো পক্ষে ডেকের উপর গাদাগাদি করে যাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য তিনগুণ ভাড়া দিয়ে এই সিঙ্গেল বেডের কেবিনটা ঠিক করেছে তাঁর জন্য। সেই সাথে কিনে এনেছে রঙিন ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনে নায়িকাদের সুন্দর সুন্দর গল্প, ভাল ভাল ছবি। বেশ মজা করেই চিত্রালী পড়ছে সে। দুলাভাই জিজ্ঞেস করছে, ‘খুব মজার কাহিনী …অ্যাঁ, একলাই পড়বা? আবার হাসবাও? আমারে ইট্টু শুনাইবা না?’
এই ধরনের মজার কাহিনী দুলাভাইকে শুনানো উচিত কিনা ভাবছে মেয়েটি। তখনই তাঁর দুলাভাইয়ের মুঠোফোনে কল আসল। লোকটা ফোন ধরল, ‘ আরে হ হ, কইলাম তো। এই এত্ত ভিড়, কোনরকমে একটা বিছানা পাইতা মানুষের মধ্যে বইসা আছি। অ্যাঁ…কী বললা? তোমার বোন? হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালই আছে। ও শুইয়া পড়ছে। তুমি কোন চিন্তা কইরো না। তবে আর একটু পরে মনে হয়, মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকব না। নদীর মইধ্যে তো। ঠিক আছে, ওকে, রাখি, জানু, ভাল থাক।’
এতক্ষণে শ্যালিকার মনে হল, সে আসলে তাঁর দুলাভাইয়ের সাথে একটা অভিসারে আছে। এবার সে ভাল করে দুলাভাইয়ের দিকে তাকাল। ওনার হাসিটা এখন যেন একটু অন্য রকম লাগছে। এই হাসি মেয়েটির কাছে অচেনা। এই হাসি দেখলে মেয়েদের হাসি পায় না, উল্টো ভয় লাগে।
হঠাৎ আমার গতি একেবারে কমে গেল। আমার গায়ে এসে ভিড়ল একটা ট্রলার। আর সেই ট্রলার থেকে ২০-১৫ জন ফেরিওয়ালা উঠেই চেঁচাতে শুরু করল, ‘এই রুডি-কেলা, রুডি-কেলা, রুডি-কেলা…। খাইয়া যান, লইয়া যান… রুডি-কেলা।’ এটা বিক্রমপুরের গজারিয়া।
কিছুক্ষণ পর রুটি আর কলা বিক্রেতারা নেমে গেল ট্রলারে করে। আমিও আবার দ্রুত চলতে শুরু করলাম। পদ্মার ঢেউয়ে দুলুনিটা মোটামুটি সহ্য হয়ে গেছে। যদিও অন্য দিনের চেয়ে দুলুনিটা বেশী, তবু এখন আর আমার তেমন ভয় করছে না। যাত্রীদের অনেকেই এখন একটু ঘুমে ঢুলু ঢুলু।
সামনের কেবিনের সেই নব-বিবাহিত দম্পতির ঘুমানোর সুযোগ নেই। আট-দশ মিলে তাঁদের কেবিনে শেষ পর্যন্ত চলছে বারবিকিউ পার্টি। খাওয়া-দাওয়া চলছে ওই একটু খানি জায়গার মধ্যে, যথাসাধ্য নড়াচড়া না করে।
ডেকের কোনার ইউনিভার্সিটির তরুণীর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। সেই জায়গায় শুরু হয়েছে তারাশংকরের ‘কবি’। পাশের তাসারুরা এখন ঘুমুচ্ছে। তাই তরুণীটি এখন বুকের উপর রেখেই বইটা পড়তে পারছে। তবে এই মুহূর্তে বইয়ের দিকে তাঁর মন নেই। সে তাকিয়ে আছে বাইরে আকাশের দিকে। নদীর বুকে শুক্লা নবমীর অর্ধেক চাঁদটা তাঁকে অন্তুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। অন্তু এখনো তাঁর শুধুই বন্ধু। তবু মাঝে মাঝে তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখে। আর কবিতার একটাই বিষয়, তা হল চাঁদ। অন্তুর চোখে সে পূর্নিমার চাঁদ, পঞ্চমীর চাঁদ আবার অমাবস্যারও চাঁদ। কবিদের প্রেম মনে হয় এমনই। কবিদের প্রেম গুরুত্ব দেবার জিনিস নয়, শুধু উপভোগের জিনিস। তবুও এখন পদ্মার জলে ভিজে থাকা চাঁদকে দেখে মনে হচ্ছে, এসময় অন্তু থাকলে মন্দ হত না, হয়তো লিখত –
চাঁদ তুমি – ঐ জলের ঠোঁটে – ঘুমিয়ে পড়া আদর
ঢেউ আমি – ভেঙে ভেঙে চলি – তোমার বাসর ঘর
ছাদের উপর বাবন এখনো নক্ষত্র নিয়েই আছে। এখন সে একটা একটা করে তারাদের নাম দিচ্ছে – ঐটা মনু পিসী, এইটা রুনু আন্টি। রুনু আন্টিকে একলা নাম দিলে আবার পিযুষ কাকা রাগ করবে। কিন্তু তারার নাম কি পিযুষ দেয়া যায়? ঠাম্মা এখন ঘুমাচ্ছে। তাঁর ঘুম ভাঙলেই জিজ্ঞেস করতে হবে।
সারেঙের কেবিনের সেই শ্যালিকার এখন প্রায় কান্না পাচ্ছে। দুলাভাই তাঁকে কেবিন থেকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। সে মোবাইল বন্ধ করেছে, এখন কেবিনের লাইট বন্ধ করতে চাইছে।