Select Page

ক’দিন ধরে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে আছি।

ডাচরা গর্ব করে হেগ শহরকে বলে ‘লিগ্যাল ক্যাপিটাল অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ – পৃথিবীর আইনী রাজধানী। তা ঠিকই আছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সবই এখানে। কিন্তু হলে কী হবে – একেবারেই নিরামিষ শহর এই হেগ। ইউরোপ সম্বন্ধে কত লাল-নীল গল্প শুনে এসেছি। তার সাথে একেবারেই যায় না। শান্ত, ছিমছাম। কোথাও আমিষ নাই।

অবশেষে একদিন পৌঁছলাম নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম। ছোট ছোট খাল ঘিরে রেখেছে শহরটাকে। সেই খালে সুদৃশ্য জলযান। তাতে চাকাওয়ালা ওয়াটার বাসও আছে। এসব জিনিস সহজেই ভেনিসকে মনে করিয়ে দেয়। এজন্যই শহরটাকে উত্তরের ভেনিস (ভেনিস অফ দ্যা নর্থ) বলে। এখানে আসতেই ইউরোপের আমিষ আমিষ গন্ধ পাওয়া শুরু হল।

Amsterdam এর ছেলেদের টি-শার্টে লিখা – I am*dam, আসলেই লম্বা লম্বা ডেম-স্টার পোলাপাইন সব। আমি সেখানে লিলিপুট। ডাচরা পৃথবীর সবচেয়ে লম্বা জাতি।

পাশেই টি-শার্ট পরা একদল মেয়ে। চোখ আটকে গেল তাঁদের টি-সার্টে। আমি চোখ সরাতেই পারছিলাম না।

ছিঃ অমন ভাবছেন কেন? এসব বিষয়ে আমি স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য। তবে এসময় মনে হয় বিবেকানন্দর চোখও আটকে যেত ওই অরেঞ্জ টি-সার্টগুলোতে। সব কটা মেয়ের টি-শার্টে লিখা – ‘Good girls go to heaven, bad girls go to Amsterdam.’

হুম, অপ্সরারা এভাবেই মুনিঋষিদের ধ্যান ভাঙত। এই তাহলে সেই ইউরোপ। সেই লাল-নীলের শহর। সাথে ভয়ও শুরু হল। সময় এসে গেছে প্রমাণ করার – সুজন, তুমি কি শুধু সুযোগের অভাবেই চরিত্রবান?

এখানে থেকে সরতে না পারলে কপালে দুর্গতি আছে। দুর্গতি এড়াতে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা দুর্গা বলে হাঁটা শুরু করলাম ভ্যান গগ মিউজিয়ামের দিকে। আজ না হয় গগের আঁকা হাফ-নুড চিত্রই দেখি। ছবিই ভালো, ছবির জ্যান্ত মডেলদের আমার সহ্য হবে না! এ যাত্রা মহামতি গগই রক্ষা করুক। তাই তাড়াহুড়ো করে হাঁটা শুরু করলাম ভ্যান গগ মিউজিয়ামের দিকে।

আমরা আমস্টারডামে গিয়েছিলাম দশ জন। কিন্তু মিউজিয়ামের কাছে পৌঁছে দেখি মাত্র তিন জন। বাকি সাত জন নেই।

ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। গগের মিউজিয়ামের টিকিটের দাম বিশ ইউরো। যেখানে প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে সারাদিন ঘোরা যায় দশ ইউরো দিয়ে, সেখানে এইসব চিত্র-টিত্র দেখতে অত খরচ না করতে চাইলে কাউকে দোষ দেয়া যায় না। আমিও দুস্থ চাকুরিজীবী।

মিউজিয়ামের কাউন্টারে বিশ ইউরো বের করতে গিয়ে আমারও মানি ব্যাগ রাখার জায়গাটা বেশ টনটন করছিল। কিন্তু বুকের বামপাশের রিনরিনে শব্দটা থামাতে পারিনি। যেতেই হয়েছিল। একঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ঢুকলাম গগের ছবির ভুবনে।

তাই বলে আমি কিন্তু মোটেও শিল্পবোদ্ধা নই। আর্টের আ পর্যন্ত জানি না। অবশ্য তাতে কোন সমস্যা হয়নি। একজন তুখোর শিল্পবোদ্ধা ছিলেন সেখানে। তিনি একজন সর্দারজী। ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের লোক।

ঘুরে ঘুরে দেখছি গগের অমর সব সৃষ্টি। শিল্প ভাল বুঝি না। তাই অনেক সময় ধরে এক একটা ছবি দেখি। যদি হিজিবিজির মাঝে একটু আলাদা অর্থ চোখে পরে। তো একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় এলেন সেই সর্দারজি। বড়ই দিলখোলা মানুষ। এসেই বলতে শুরু করলেন,
‘ক্যায়া ভাই, বহুত বড়িয়া আর্ট হ্যাঁয়। ও দেখলিয়ে জি …’
আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি বাংলাদেশ থেকে, হিন্দি ভাল বুঝি না।’
‘কোই বাত নেই, কোই বাত নেহি। আংরেজি ভি বহুত আতা হায়। জরুর আতা হায়।’

এই বলে ইংরেজিতে বলা শুরু করলেন, “ভাই, চোখের সামনে কী দেখছি! এ কী শিল্প! আহাহা, আরো আগে কেন এখানে এলাম না। এরকম জিনিস ভ্যান গগ ছাড়া পৃথিবীর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়।”

আমি শুধু মাথা নাড়ছি। শিল্প তো একেবারেই বুঝি না। কী বলতে কী বলে ফেলব! তাঁর চেয়ে – সাইলেন্স ইস গোল্ডেন।

তিনি বলে চলছেন, “এই যে হাতের রেখাগুলো এঁকেছে – কত গভীর অন্তঃদৃষ্টি ভ্যান গগের। কী স্পষ্ট! কী পারফেকশান। একেবারে গগের ইউনিক স্টাইল। আপনি বলুন ভাই, আর কোথাও অমনটা দেখেছেন।”
‘না’

‘আরে দেখবেন কোত্থেকে? আমি পৃথিবীর সকল বড় বড় আর্ট মিউজিয়াম ঘুরেছি। এ জিনিস কোত্থাও দেখি নি। গগ ছাড়া এ জিনিস আর কেউ আঁকেননি। এটাই গগ। একেই বলে গগীয় চিত্রকলা।’

ততক্ষণে সর্দারজীর চারপাশে লোক জড়ো হয়ে যাচ্ছে। হবে না? অমন শিল্পবোদ্ধা যে ওখানে একজনও নেই। অমন লাইভ কমেন্ট্রি বিনা পয়সায় কে দিবে? এবার আমি তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বললাম,
‘সর্দারজি, যা বললেন ঠিকই আছে। শুধু একটাই সমস্যা। এই ছবিটা ভ্যান গগের আঁকা নয়। তাঁর ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের সাথে এই ছবির সূক্ষ্মতার কোন মিল নেই।’

‘কি বলছেন আপনি?’
‘এই নিচের ডান কোনায় দেখুন। অন্য শিল্পীর নাম লেখা।’

বলতে বলতে আমি মাথা নিচু করেছি। মাথা তুলে দেখি সর্দারজি হাওয়া। একেবারে গায়েব হয়ে গেছেন। আহা অমন শিল্পবোদ্ধাকে আর খুঁজে পেলাম না।

// আই এম স্টার ডেম //© সুজন দেবনাথ