হোমার-সাগরে হিমালয় -এর রিভিউ
বইয়ের নাম: হোমার-সাগরে হিমালয়
কবি: সুজন দেবনাথ
প্রচ্ছদ: নিবেদিতা নাথ
প্রকাশকাল: অক্টোবর/২০২১
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬৪
মলাট মূল্য: ১৮০ টাকা
প্রকাশক: চৈতন্য প্রকাশন
শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস‘হোমার-সাগরে হিমালয়’:ওয়াসিম হোসেন
কবিতা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি, চিন্তা। যা উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত হয়। তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্য ও পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে।
তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ কবিতা, অথচ এর বিশালতা আর গভীরতা অকল্পনীয়। কবিতা হাসায়, কবিতা কাদায়, কবিতা আনন্দ দেয়, বেদনা শেখায়। কবিতা আলোর পথের সন্ধান দেয়, জ্ঞানের কথা বলে।
কবির যাপিত জীবনের অন্তক্ষরণ, মোহ, মুগ্ধতা, বিস্ময়, বিদ্রোহ নিয়েই সুজন দেবনাথের কাব্যগ্রন্থ ‘হোমার-সাগরে হিমালয়’। এ যেন শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস।
বইয়ের কবিতাগুলো অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ, এসব কবিতায় আছে আবেগ, প্রেম, ভালবাসা, সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ, বাবার দেখানো পথের দিশা, বোনের প্রতি ভালবাসার উদাহরণ, বেকারের কষ্ট, প্রেমিকের ভালবাসার বির্সজনের ব্যথা ভুলাবার মন্ত্র। সর্বপরি আমার কাছে কবিতাগুলো ভাল লেগেছে বিশেষ একটি কারণে, অসংখ্য চিরন্তন কিছু প্রশ্নের সহজ উত্তর পেয়েছি ‘হোমার-সাগরে হিমালয়’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতায়।
বলা হয়ে থাকে কবিতা সাহিত্যের অগ্রগামী শাখা। আমার মনে হয়েছে, কবি সুজন দেবনাথ তার সময়ের চেয়েও অগ্রগামী। প্রতিটি কবিতায় কবির আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ সবাইকে মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি লিখেছেন,
‘হোমার-সাগর দেখতে যাবো। জাহাজে উঠেছি। ভাবছো, এই নাম কোথায় পেয়েছি?/সেই প্রথম যেদিন অডিসিয়াস পড়েছি, গ্রিসের সাগরগুলোর নাম কেটে, আমি/হোমার-সাগর রেখেছি। সাগরে চোখ মেলে মনে হচ্ছে, এই সাগর আমি দেখেছি,’ [কবিতা : দুঃখের মত বেহায়া]
কবি তার কবিতায় হোমার সাগরের বর্ণনায় মশগুল হয়েছেন। কিছু কবিতা জীবনের কথা বলেছে। তিনি ‘চাকরি’ শিরোনামে লিখেছেন-
‘বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু বেচে ফেলার নামই’
মহামারী করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তাই কবিও আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা ভেবেই হয়ত লিখেছেন, ‘
‘ফুলদানি আর ছাইদানিÑ দুটোই আসলে কফিন/একটি ফুলের মৃত্যুর জন্য, অন্যটি ধূমপানকারীর।’ [কবিতা: কফিন]
কবি সুজন দেবনাথ একটি পাখির ভিসাহীন ভ্রমণের কথায় লিখেছেন-
‘একটি অতিথি পাখির কাছে হেরে গেছে রাষ্ট্র, মুছে গেছে সীমানা
পাখিটি দেশে দেশে ঘুরছে ভিসাহীন পালকেই লিখছে ঠিকানা’ [অতিথি-পাখি]
সন্তানের জন্য মায়ের কতটা আত্নত্যাগ সেটি যুক্তি ও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন কবি তার ‘মায়ের বলিরেখা’ কবিতায়-
‘একটি মেয়ে যুদ্ধ করছেন সূর্যের সাথে, অল্প বয়স থেকে/ সূর্যের সাথে কেউ জিততে পারে না, তিনিও পারেননি।/তিনি জানতেন, হারবেন তবু পথ ছাড়েননি।/ আমি সেই পথে পৃথিবীর সাথে পঁচিশটি সূর্য পার হয়ে/ দেখি তার মুখে অনেক যুদ্ধ-চিহ্ন, অনেক বলিরেখা।/মেয়েটি সূর্যের সাথে যুদ্ধ করেছেন, খুব অল্প বয়স থেকে/এই যোদ্ধা মেয়েটিকে আমি মা নামে ডাকি, জন্ম থেকে। ’
আজকাল কেউ কেউ ফেসবুকেও সমাজ বদল করে, সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে কত ফন্দি। ‘ফেইসবুকে সমাজ বদল’ নামে লিখেছেন কবিতা-
‘বাবুল এখন আর খবর দেখে না, সে এখন খবর বানায়।/সেলফির হাতে আমিত্ব তুলে দিয়ে, নিজেই খবর হয়/দরকারে খবর বানায়, অদরকারেও আরো বেশি বানায়/ খুব বিশেষজ্ঞ ভাব নিয়ে ফেইসবুকে সমাজ বদলায়/ খবর হবার জন্য রাতদিন অনলাইনে মাথা চাপড়ায়’
ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে নিজেকে সান্তনার কথা আছে ‘হোমার-সাগরে হিমালয়’ কাব্যগ্রন্থে। কবি লিখেছেন-
‘তুমি অন্যের বউ হয়ে ভালই হয়েছে। আমার এই ছোট চাকরি,/
ছোট ঘর জানালা তো আরো ছোট। তোমার খুব কষ্ট হতো।/আমার ছোট মানিব্যাগ, বাজার আঁটে না, এখন হাট-বাজার সব বড় বড়/আমার মানিব্যাগের মাপে বাজার ঢাকা শহরে আর পাওয়াই যায় না।’ [অন্যের বউ]
যে কবিতাটি আমার মনের মধ্যে জমে থাকা হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, তা হলো ‘ ঈশ্বরের অসমাপ্ত কবিতা’ শিরোনামের কবিতাটি। সেখানে তিনি লিখেছেন-
‘পৃৃথিবী ঈশ্বরের অসমাপ্ত কবিতা/তিনি কবিতাটি শেষ করেননি/হয়তো শেষ করার ইচ্ছা তার ছিলো না/মানুষ ঈশ্বরের শেষ না করা কবিতাটি লিখছে... নিজের মত করে লিখছে.../ভুলভাল লিখছে, লিখছে আর কাটছে, কেটে কেটে লিখছে, লিখে লিখে/ কাটছে। কবিতাটি লিখতে লিখতে মানুষ ঈশ্বরকে লিখছে, ভুলভাল লিখছে,/লিখছে আর কাটছে, কেটে কেটে লিখছে, লিখে লিখে কাটছে। কবিতা নিয়ে/মারামারি চলছে। মানুষ ঈশ্বরকে নিয়ে অযথা মারামারি করছে।/শান্তির নামে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে যুদ্ধের নামে শান্তি শান্তি খেলছে। তবু/কবিতাটি শেষ হচ্ছে না, হাজার বছর চেষ্টা করেও শেষ করা যাচ্ছে না। হয়তো কবিতাটি শেষ হবার নয়, শেষ হবার হলে ঈশ্বর নিজেই করতেন।’
চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সুজন দেবনাথের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘হোমার-সাগরে হিমালয়’। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নিবেদিতা নাথ। প্রচ্ছদ বেশ মানানসই হয়েছে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো অনুসারে।
অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: