Select Page

২০১৩ সালের ডিসেম্বর। আমি ক্যানবেরায়। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হলে থাকি। হলের নাম টোড হল। পুরোপুরি ইন্টারন্যাশনাল হল এই টোড। ৫-৭ জন মাত্র অস্ট্রেলিয়ান, তাও অস্থায়ী, বাকি সব শিক্ষার্থী বিভিন্ন দেশের। যতদূর মনে পড়ে, সেই সময় ৫৬ টি দেশের শিক্ষার্থী ছিলো এই হলে। একটি মাত্র বিল্ডিংয়ে এরকম মাল্টি-ন্যাশনাল পরিবেশ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। বিভিন্ন রঙয়ের, বিভিন্ন ভাষার মানুষের এই মিথস্ক্রিয়ার জন্য আমি টোড হলকে বলতাম – রংধনু হল। রংধনুর সাত রঙয়ের মত বৈচিত্রমাখা পরিবেশ টোড হলের।

এই মাল্টিন্যাশনাল টোড হলে এশিয়ান শিক্ষার্থীই বেশি ছিল। তাঁর পরেই আফ্রিকান। আর আফ্রিকানরা যেখানেই যাবে সেখানেই হই-হুল্লোর। সুযোগ পেলেই গলা ছেড়ে গান আর কোনমতে একটু মিউজিকের সুর কানে আসলেই তাতা থৈ থৈ নয় – একেবারে সারা শরীর দুলিয়ে পলিরিদমিক বান্টু নাচ। নাচে গানে সব আফ্রিকানই আসলে এক একজন ক্রিস গেইল। পাশে বসে তুমি হাসো, কাঁদো, বিরক্ত যাই হও না কেন – তাতে ওর কিচ্ছু যায় আসে না। তুমি ওর সাথে নাচলে সানন্দে গ্রহণ করবে, হাততালি দিলে উৎসাহ পাবে, আর গোমরা মুখে বসে থাকলে হাত ধরে জিজ্ঞেস করবে – কি হয়েছে মাইফ্রেন্ড- গালফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ? আনন্দ দেয়া-নেয়ার এই দর্শন ওরা জন্ম থেকেই পেয়েছে।

জীবনকে জলিভাবে নেয়ার এই সুন্দর সংস্কৃতি এই যান্ত্রিক জীবনের স্ট্রেস কমানোর জন্য একটা চমৎকার টনিক। ওরা ওদের আবেগ, অভিব্যক্তি সব প্রকাশ করে দেয়। আর এশিয়ানরা সব কিছুতেই সিরিয়াস। অত সিরিয়াস জীবন যাপন করে এশিয়ানরা কি পাচ্ছি জানি না।

আমরা সব ভেতরে পুষে রাখি – আনন্দের সাথে কিছুই বিলিয়ে দেই না, নিজের ভেতরে জ্বলতে থাকি আর এক সময় সুযোগ পেলেই অন্যকে জ্বালাই, জ্বালিয়ে সুখী হই। সেটাই আমাদের সুখের দর্শন। এই হিসেবে আমার মনে হয়, জীবন ধারায় আফ্রিকানরাই সুখী। বিশ্ব হ্যাপিনেস ইনডেক্স হয়তো অন্য কথা বলবে। কিন্তু সামনাসামনি মিশলে মনে হবে একজন আফ্রিকান মানুষ একজন এশিয়ানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুখী। এই সুখ পয়সা দিয়ে পাওয়া যায় না। উচ্চশিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীতেও পাওয়া যায় না। এই সুখ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এই বিবেচনায় আফ্রিকান সংস্কৃতিকে আমি বলি ‘হাসিমাখা সংস্কৃতি’। মনের জ্বালা ঝেড়ে ফেলার জন্য এই সংস্কৃতিকে খুবই পছন্দ করি।

আমার টোড হলের সময়ে সেই হাসিমাখা আফ্রিকান সংস্কৃতির স্পষ্ট প্রমাণ হয়ে হলের সবখানে ঘুরে বেড়াত একটা চিকন ছিপছিপে মেয়ে। মেয়েটার নাম মিমি। বাড়ি তাঞ্জানিয়ায়। কৃষ্ণাঙ্গ এই সুন্দর মেয়েটা সব সময় হাসছে। এমনি এমনি, নিজে নিজে হাসছে – আর সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই হাসাচ্ছে। ওর সুন্দর কালো মুখে সারাক্ষণ সাদা দাঁতগুলো চকচক করতো। রবীন্দ্রনাথ ওরে দেখলে নিশ্চিত আরো কয়েকটা ‘কৃষ্ণকলি’ টাইপের গান লিখে ফেলতেন।

মিমি আমার ক্লাসমেটও ছিলো। ডিপ্লোম্যাসি কোর্সের প্রথম দিন কোন কথা নেই বার্তা নেই, সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো – ‘হেই, আর ইউ এ মিনিস্টার?’

কি বলছে – বুঝতেই সময় লাগলো। মুখ দেখে বুঝলাম জোক করছে। বললাম – ‘হুম, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাকি হারিকেন দিয়ে লোক খুঁজছে মিনিস্টার করার জন্য। এখনো কাউকে পায় নাই। চলো – তুমি আমি দুজনেই এপ্লাই করি।’ বলতে বলতে হেসে ওঠলাম। শুধু স্বতঃস্ফুর্তভাবে হাসার জন্য এরকম প্লান করে মজা করত মিমি।কিন্তু এক সন্ধ্যায় আমার রুম থেকে দেখি বাইরে বসে আমাদের চিরহাস্যোজ্জ্বল মিমি কাঁদছে। হলের লনের ঘাসের উপর ছোট্ট টেবিলে মুখ রেখে ঝরঝর করে কাঁদছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মিমি কাঁদছে? মিমির মত মেয়ের চোখে জল? তাও এমন বাঁধভাঙা কান্না? নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু। দৌড়ে নিচে গেলাম। সামনে যেতেই মিমি চিৎকার করে ওঠলো – ‘সুজন, মাদিবা ইস নো মোর।’

মাদিবা মারা গেছেন। ন্যালসন ম্যান্ডেলা মারা গেছেন। আফ্রিকার মানুষের সবচেয়ে আদরের মানুষটি পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। তাই মিমি কাঁদছে। ম্যান্ডেলা আমারও আইডল। ছোটবেলা থেকে জীবত মানুষদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকজন যাদেরকে বিনা প্রশ্নে শ্রদ্ধা করেছি – তাঁর মধ্যে ম্যান্ডেলা সেরা। আমারও মনে হলো খুব আপন কেউ আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। সহানুভুতি আর কষ্ট নিয়ে মিমির দিকে তাকালাম। মিমির দাঁত আর চোখের জল দুটোই চকচক করছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা পবিত্র কান্না দেখলাম। ততক্ষনে হলের অনেকে চলে এসেছে সেখানে। আমি রুমে ফিরে গেলাম।

মনে পড়ল – আমার দাদু ছোট বেলায় ম্যান্ডেলার কথা বলতেন। ম্যান্ডেলা একটা রংধনু দেশ বানাতে চায় আফ্রিকাতে। সেখানে সাদা কালো সবাই সমান হবে। রংধনু দেশ চাওয়ার অপরাধে ২৭ বছর তাঁকে রোবেন দ্বীপের অন্ধকার কারাগারে আটকে রেখেছিল সভ্য সাদা শিক্ষিত মানুষেরা। মনে পড়লো আমি ছোট্ট বেলায় স্বপ্ন দেখতাম- একটা কাঁচরঙের ঘোড়ায় আমি ঘুরতে গেছি ম্যান্ডেলার দেশে – রোবেন দ্বীপের অন্ধকার কারাগারের ছোট্ট ফুটো দিয়ে আমার সাথে হাত মিলাচ্ছেন ম্যান্ডেলা। সেই সন্ধ্যায় ‘রংধনু পৃথিবী’ নামে একটা কবিতা লিখলাম ম্যান্ডেলার স্মরণে।

এর কয়েকদিন পর মিডিয়ায় একটা ছবি নিয়ে ভীষণ তোলপাড়। একটা সেলফি নিয়ে। ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে নিয়ে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী সেলফি তুলছেন। সেলফিতে তিনজনই হাসছেন। চারিদিকে রে রে পড়ে গেলো। নিউজ চ্যানেল আর ফেইসবুকে ঝড়। সবাই বলছে – শোকের অনুষ্ঠানে সেলফি? ভালোবাসার ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সেলফি? মানুষ আর কত নিচে নামবে? ওনারা তো রাস্তাঘাটের কেউ নয় – তিন তিন জন সরকার প্রধান – এমন করতে পারলো?

ছবিটা দেখে আমিও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। আমিও ম্যান্ডেলাকে ভালবাসি – সে আমার ছোটবেলা হিরো, আর বড়বেলাও হিরো। দুদিন আগেই তাঁর মৃত্যুতে কবিতাও লিখেছি। আর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাঁকে আপমান? ছি…! এই ছি ছি ভাবের মধ্যে হঠাৎ মনে পড়ল মিমির কথা।ছবিটা নিয়ে মিমি কি ভাবছে? ম্যান্ডেলার অপমানে ওর প্রতিক্রিয়া জানতেই হবে।

খোঁজ নিলাম মিমির। কিন্তু অবাক করে মিমি বললো, ‘আমি ছবিটা দেখেছি। ঐ অনুষ্ঠানে সেলফি তোলা তাঁদের উচিত হয়নি। কিন্তু ওনারাও মানুষ। ক্ষণিকের আবেগে হয়ে গেছে। এখন সেলফি নিয়ে সবাই মাতোয়ারা। এই ক্রেজে ‘সেলফি’ শব্দটি এবছর অক্সফোর্ড ডিকশনারির ‘ওয়্যার্ড অফ দ্যা ইয়ার’ হয়েছে। হয়তো ওখানে গেলে আমিও একটা সেলফি তুলতাম। লেটস ফরগেট ইট।’ আমি ভীষণ আশ্চর্য হলাম মিমির উত্তরে। সেলফিটা দেখে ম্যান্ডেলার অপমানে আমি রাগে জ্বলে যাচ্ছি। কিন্তু মিমি বিষয়টা একদমই সিরিয়াসলি নিলো না। বললো – লেটস ফরগেট! আমি ওদের সংস্কৃতির অন্য একটা দিক দেখলাম। নতুন কিছু শিখলাম।

মিমি ম্যান্ডেলাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে। খুব কাছের মানুষ ছাড়া অন্য কারো জন্য অমন কান্না আমি জীবনে দেখিনি। সেই মিমি এমন সহজভাবে নিলো প্রেসিডেন্ট ওবামার সেলফিকে। হয়তো ঈশ্বর মানুষকে আলাদা কিছু গুণ দিয়েছেন। ভালোবাসার সুন্দর প্রকাশকেই হয়তো ঈশ্বর ভালোবাসেন। মিমি এই জায়গায় আমার থেকে অনেক বড়। এখানে মিমির কালো রঙয়ের উজ্জ্বলতা আমার বাদামী রঙের থেকে অনেক বেশি। মিমিদের হাসিমাখা সংস্কৃতিকে ভালবাসি। রংধনু পৃথিবীর স্বপ্নকে ভীষণ ভালোবাসি।

// হাসিমাখা সংস্কৃতি// © সুজন দেবনাথ