Select Page

বাংলাদেশীরাই গ্রীসে ক্রিকেটের অগ্রদূত। তাঁরা গ্রীসের মাটিতে ক্রিকেট খেলল। গ্রীকদের নিয়েই খেলল। ক্রিকেট তাঁর নতুন যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশীদের হাত ধরে। দূতাবাস শুরু করলো Sports Diplomacy. আয়োজন করলো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। টুর্নামেন্টের নাম ‘প্রথম বাংলাদেশ-গ্রীস ফ্রেন্ডশিপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’।

টুর্নামেন্ট আয়োজনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন গ্রীসের সরকার। গভীর মমতা নিয়ে পাশে দাড়িয়েছেন এখানকার মন্ত্রীরা। এথেন্স থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অজপাড়া গাঁয়ের মাঠে ছুটে এসেছেন তাঁরা। ফাইনাল ম্যাচে অতিথি ছিলেন গ্রীসের শ্রমমন্ত্রী। আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশী দরকার তাঁকে। উদ্বোধনী ম্যাচে আসলেন ক্রীড়া উপমন্ত্রী।

মানোলদার বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গ্রীসের মন্ত্রীদের হাতে তুলে দিলেন ক্রিকেট ব্যাট। তাঁরাও ক্রিকেট খেললেন। তাঁদের জীবনের প্রথম ক্রিকেট। খেললেন আমাদের সাথেই। সাথে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, রিজিয়নাল গভর্নর, মেয়রসহ সকল স্তরের গ্রীক বন্ধুরা। সক্রেটিসের উত্তরসূরীদের আমরা ক্রিকেটের নেশা ধরিয়ে দিলাম।

খেলতে এগিয়ে এসেছেন মানোলদার খামারের মালিকরা। তাঁরাও অংশগ্রহণ করেছেন এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টে। কিন্তু তাঁদের অনেকেই জীবনে কোনদিন ক্রিকেটের নামও শোনেননি। তাঁরা কী করে খেলবেন? তাই তাঁরা হলেন দলের ম্যানেজার। দলের ফ্রাঞ্চাইজি। তাঁরা সপরিবারে এসে সাপোর্ট করলেন তাঁদের দলকে। তৈরি হলো সাম্য। মালিক-শ্রমিক সাম্য। সেই সাথে তৈরি হলো বাংলাদেশ-গ্রীস বন্ধুত্বের একটা অন্য উঠোন। ক্রীড়া-কূটনীতির (Sports Diplomacy) উঠোনে হাঁটতে শুরু করল বাংলাদেশ-গ্রীস।

৪ টা দল অংশ নিয়েছে টুর্নামেন্টে। দলের নাম কি? বাংলাদেশের নদী আর গ্রীসের স্থানের নাম মিলিয়ে চারটা দলের নাম হলোঃ পদ্মা-মানোলদা, মেঘনা-মানোলদা, যমুনা-লাপ্পা এবং সুরমা-লাপ্পা। টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হলো যমুনা-লাপ্পা। না, ভুল বললাম। চ্যাম্পিয়ন হলো ক্রিকেট। জয়ী হলো প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তাঁরা প্রমাণ করলো তাঁরা শুধু সেখানে মাঠেই কাজ করে না। একটা গর্বিত দেশের গর্বিত নাগরিক যারা কোন একটা খেলায় বিশ্বে সেরা।

এখন মানোলদায় বাংলাদেশীরা বিশেষ কিছু। তাঁরা শুধুই কৃষি শ্রমিক নয়। তাঁরা সেখানে একা নয়। তাঁদের পাশে আছে বাংলাদেশ সরকার। তাঁদের কাছে আছে বাংলাদেশ দূতাবাস। তাঁদের জন্যই মানোলদার মত অজপাড়া গাঁয়ে ছুটে আসে গ্রীসের মন্ত্রীরা। স্থানীয় গ্রীকরাও বুঝলেন বাংলাদেশীরাও কারও চেয়ে কম নয়, বরং অনেক জায়গায় বাংলাদেশীরা ছাড়িয়ে গেছে এরিস্টটলের দেশকে। স্থানীয় গ্রিক ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে এই টুর্নামেন্ট। স্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল খেলাটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছু অংশ সরাসরি সম্প্রচার করে।

আর আমি? চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি – পড়ন্ত বিকেলের রোদে বেগুনী-সাদা জার্সি পরে হেঁটে যাচ্ছে কয়েকটি তরুণ। বাংলাদেশী তরুণ। তাঁদের হাতে বিজয়ের সোনালী ট্রফি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের হাত থেকে পাওয়া ট্রফি। গ্রীক মন্ত্রীদের ভালোবাসা মাখা ট্রফি। তাঁদের শরীরে ভিকটরী ল্যাপের ভাষা। তাঁদের হাতে গ্রীস আর বাংলাদেশের ছোট ছোট পতাকা। তাঁরা হাঁটছে। গ্রীসের মাটিতে হাঁটছে। আর রাস্তের পাশে গ্রীক জনগণ তালি দিচ্ছে। গ্রীক ভাষায় অভিনন্দন জানাচ্ছে। এমন ঘটনা অন্তত মানোলদার বাংলাদেশীদের জীবনে আগে ঘটেনি।

মনে পড়লো রবিবাবুর গান – ‘আজি প্রাতে সূর্য্ ওঠা সফল হলো কার?’
না, তখন সকাল ছিল না, ছিল বিকেল। তাই সূর্য্ ওঠা নয়, সূর্য্ ডোবা। মানোলদায় সেদিনের সেই অপরাহ্ন সূর্য্টা ডোবার আগে অবশ্যই ওদেরকে বিজয় তিলক পরিয়ে দিয়েছিল। গ্রীসের মাটি ওদের সালাম করছিল। পাশের স্ট্রবেরি ক্ষেত থেকে লাল স্ট্রবেরি হেসে হেসে ওদের বিজয় উদযাপন করছিল। সেই দিন থেকে তাঁরা নতুন মানুষ। শুধু স্ট্রবেরি শ্রমিক নয়। গ্রীসের মাটিতে দেশের পতাকা হাতে ওরাই এক একজন প্রতিনিধি।

১১ জুন, ২০১৬, এথেন্স, © সুজন দেবনাথ