Select Page

রাজীব অহংকারী – একথা আজ পর্যন্ত কেউ বলে নি।

সে নিজে কখনও টের পায়নি যে তাঁর ভেতর অহংকার বলে কিছু ছিল। তবে আনন্দের হাতে ঠিক সময়ে ব্রেক তুলে না দিলে সেটা অহংকার হয়ে যায়। খুব আনন্দে আছে রাজীব। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। ক্যানবেরা শহরে পড়তে এসেছে। বিদেশে একটা ভাল ইউনিভার্সিটিতে পড়া তাঁর অনেক দিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পেটেই মনে হয় এই অহংকারটা ছিল – এখানে এসেই প্রসব করে ফেলেছে। তাই নিজেকে এখন মনে হচ্ছে একজন অনিচ্ছুক পিতা যিনি ক্ষণিকের ভুলে জন্ম দিয়ে ফেলেছেন একটা আচেনা অহংকার।

ইউনিভার্সিটিও ভীষণ পছন্দ হয়েছে রাজীবের। ক্লাশে বেশ একটা মাল্টিকালচারাল পরিবেশ। অস্ট্রেলীয়দের পাশাপাশি চীনা, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়ান, ইউরোপীয়ানসহ আরো অনেকে মিলে মিশে একেবারে হরেক মালের দোকান। তাই ক্লাশেও ভালই লাগে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয় না। আনন্দ আর অহংকার মিলে ভাল থাকারই কথা।

তবু ওই আনন্দটা মাঝে মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মনে হয় কী যেন নাই। কোথায় কিছু একটা মিসিং। হঠাৎ হঠাৎ একটা থুত্থুরে বিষণ্ন ব্যাঙ তাঁর ভিতর ঘেংয়র ঘেংয়র করে।
কারণ খোঁজে রাজীব। সবই তো ঠিক আছে। ফোনে, স্কাইপে মা বাবার সাথে নিয়মিত কথা বলছে। বিদেশে থাকার জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। হোমসিক-টিক নিয়ে মাথার নিউরনকে নষ্ট করে না সে। তবু স্বস্তি পাচ্ছে না। বিষণ্ণতার সূত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল সে।

‘হেই রাজ, কাম হিয়ার, বাডি – কাম হিয়া…’
রাজীবকেই ডাকছে। ডানদিকের একটা ক্যাফে থেকে। সেখানে কয়েকজন সহপাঠী আড্ডা দিচ্ছে। তাঁদের সাথে যোগ দিয়ে মজা করতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু এসব আড্ডায় সে প্রান পাচ্ছে না। সেখান থেকে বের হয়ে আবার এলোমেলো হাঁটতে লাগল।

হঠাৎ গাছের উপর একটা কোকিল ডাকল, কুহু।
ক্যানবেরায় এখন বসন্ত চলছে। তবে কোকিল নিয়ে আদিখ্যেতা করার মত ছেলে রাজীব নয়। ওসব অকর্মণ্য কবিদের কাজ। কিন্তু কোকিলটার ডাক তাঁর আবার শুনতে ইচ্ছা করছে। এত মধুর লাগছে কেন? কোকিলটা আবার ডাকল – ‘কুহু’।

আরে, এতো বাংলায় কুহু বলছে! তাই এত আপন লাগছে!

বাংলা – সে কতদিন প্রাণ খুলে বাংলা বলতে পারছে না। এ ক’দিনে রাস্তায় কাউকে সে বলে নাই, ‘ও বাবুল ভাই, তুমুল যৌবনতো হুদাই গেল। আর কতদিন আযান দিয়া খাইবেন। এইবার আমাগো একটা ভাবী দেন, আমরা শুধু নাভী দেখুম। বাকি সব আপনার।’

  • ‘বাংলা কথার জন্যই আমার চারদিক খা খা করছে। বাংলার অভাবেই আনন্দ ভাঁড়ার খালি হয়ে গেছে।’

বিদেশে থাকার অস্ত্র-শস্ত্র ঝালিয়েই এসেছে সে। তাঁর ইংরেজিও বেশ চোসত। কিন্তু মাতৃভাষা যে তাঁকে এভাবে পোড়াবে তা সে আগে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারে নাই। এই প্রথম বিদেশে এসে তাঁর চোখের কোনে জল এল। থামাতে পারছে না, সে এত ভালোবাসে বাংলাকে!

রাজীব খুঁজতে লাগল কাছাকাছি কোথাও কোন বাংলা শোনা যায় কিনা। না, শুনতে পাচ্ছে না। এখানে নদীর পারে লাইন দিয়ে ইটের ভাটাগুলো বাংলায় ভটভট করছে না। ঢাকার রাস্তার মত প্রতিটা গাড়ি ত্রিশ সেকেন্ড পরপর বাংলায় পোঁ পোঁ করছে না। এমনকি বাংলাদেশের গরুর সমান সাইজের কুকুরগুলো পর্যন্ত একবারও বাংলায় ঘেউ করছে না!

তিন সপ্তাহেই সে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। এরমাঝে এক ভারতীয় ছাত্র কৌশিক হোস্টেলে উঠল, তাঁর পাশের রুমেই। রাজীব যেন বেশ কাছের একজনকে পেল। শুরু করল আলাপ, প্রথমে ইংরেজিতেই।

কিছুক্ষণ পর কৌশিক বলল, ‘তুম হিন্দিমে বাতাও না ইয়ার।’

হঠাৎ যেন তাঁর স্বরতন্ত্রে কেউ গ্রেনেড মারল। সে কিছু না বলে উঠে চলে এল। কৌশিক বেচারা হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

কেন এমন হল! হিন্দির প্রতি তো তাঁর কোন বিরাগ নেই। মাকে তো যখন তখন বলত, ‘নেহি হোগা, কাভি নেহি।’ বন্ধুদের জন্য তাঁর প্রিয় গালি – ‘ছালে বঞ্চিত বাঞ্চোত’!

তবু এ প্রবাসে তাঁর মুখ দিয়ে হিন্দি এল না! কৌশিকের তো দোষ নেই, সে নৈকট্যকে সহজ করতেই হিন্দির কথা তুলেছিল। কিন্তু রাজীব এখন এ পরবাসে হিন্দি বলতে পারবেই না।

সে ক্যানবেরার গাছের ডালে শনশন শব্দ শোনে – ওইতো বাংলা। লেকের জলে ছলাৎ ছলাৎ সুর – ওইতো বাংলা। হঠাৎ ফেইসবুকে দেখল – এক বন্ধু শহীদ মিনারের উপর বাংলা অ আ দেয়া ফটো দিয়েছে। এবার সে বুকের মধ্যে ছলাৎ শব্দ শুনতে পেল। আর দুদিন পরেই একুশে ফেব্রুয়ারি – বাংলা ভাষার মহান একুশ, অমর একুশে।

সে জীবনে কতগুলো একুশ কাটিয়েছে। ছোট্টবেলায় স্কুলে প্রভাত ফেরীতে গিয়েছে, বন্ধুদের সাথে গেয়েছেও – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ তা সবই ছিল আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু আজ যেন তাঁর ভেতরের কোন গোপন কোঠায় প্রতিধ্বনি হচ্ছে- একুশ, বাংলা ভাষার একুশ, অমর একুশ, আমার একুশ।

-‘হুম মায়ের ভাষার জন্য বুলেটের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব, সত্যিই সম্ভব।’

অন্তর্জালে (ইন্টারনেটে) একুশের ইতিহাস পড়তে শুরু করল রাজিব। একেবারে ৪৭ থেকে ৫২ পেড়িয়ে ৯৯ এ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা পর্যন্ত – সে এক রোমাঞ্চিত ইতিহাস। আর কোন জাতির নেই। আর কোন ভাষার এমনটা নেই।

এমন রোমাঞ্চিত ইতিহাস সে এতদিন জানত না ভেবে অবাকই হল! অথচ নিজেকে কত জ্ঞানী মনে করত সে। এখন অবশ্য কুয়ার ব্যাঙ মনে হচ্ছে। রাজীব ভাবল, ও নিজেই শুধু অজ্ঞ, সারা পৃথিবীর সবাই নিশ্চয়ই এ ইতিহাস জানে এসব কথা। অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস এখন পৃথিবীর সকল শিক্ষিত মানুষই জানে। গর্বে তাঁর মন ভরে গেল।

আজ অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ভাললাগা নিয়ে ক্লাসে গেল রাজিব। সুযোগ পাওয়ামাত্র এক অজি সহপাঠীকে জিজ্ঞেস করল মাতৃভাষা দিবসের কথা।

  • ‘স্যরি বন্ধু, সেটা কি?’

খুবই হতাশ হল। পাশের এক চীনা ছাত্রকে একই কথা জিজ্ঞেস করল। চীনের বন্ধু উত্তর দিল, ‘স্যরি বন্ধু, চীনে আমরা ইংরেজীটা এত কম পড়ি যে, বিশ্ব ইতিহাস আমরা প্রায় জানিই না।’
প্রায় সবাই একইরকম উত্তর দিল।

আবার শুনল এক মেয়ে পাশের জনকে ফিসফিস করছে, ‘দিস গাই ইস টকিং বুলশিট।’

সে ক্ষান্ত দিল। ভীষণ হতাশ। এমন গৌরবের ইতিহাস মানুষ জানেই না! অন্যদের অহংকার নিয়ে আমরা নিজেরা কত গৌরব অনুভব করি। আর নিজেদের গর্বের কথা তেমন কেউ জানেই না।

আজ একুশ তারিখ – একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল হতেই রাজীব সব কটা খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে খুঁজল – বাংলাদেশ হাইকমিশন নিশ্চয়ই ক্রোড়পত্র ধরনের কিছু দিয়েছে। না কিচ্ছু নেই, মহান একুশ বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কোন নাম-গন্ধ কোন পেপারে নেই।

-না, এ হতে পারে না, কিছু একটা করতেই হবে, মানুষকে জানাতে হবে তাঁর প্রিয় বাংলা ভাষার বিজয় আখ্যান।

রাজীব ক’জন বাঙ্গালীকে ফোন দিল, কিছু করতে হবে।

সবাই বলল, ‘ওহ রাজীব, গ্রেট, ক্যারি অন, ক্যারি অন। ইশ, আগে বললে আজ ডে-অফ নিতাম।’

হঠাৎ টেবিল কাভারের কালো কাপড়টা টেনে নিল। সেটা কেটে কালো পতাকা বানিয়ে ফেলল। সোজা চলে গেল অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউসের সামনে। সেখানে একাকী কালো পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর কী করতে পারে একা সে!

একটু দূরে একলোক গিটারে বব মার্লোর গান গেয়ে ভিক্ষা করছিল। রাজীবকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এল।

বিষয়টা শুনে বলল, ‘আমি লুইস, একজন অস্ট্রেলীয় আদিবাসী। আমরা আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আর তোমরা রক্ত দিয়ে টিকিয়েছ তোমাদের মাতৃভাষা। গ্রেট, ক্যান আই সিং ফর ইউ?’

রাজীবতো অবাক, সে গাইতে শুরু করল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’

কিছুক্ষণের মধ্যেই লুইসও গিটারে গানটা তুলে ফেলল। রাজীব গাইছে আর লুইস গিটার বাজিয়ে বাংলিশ উচ্চারণে টান দিচ্ছে,… ‘হামি কি বুলিতে পারি।’

কিছু দূরে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি বা পাত্তা দেয়নি। এবার কালো পতাকা আর ভীনভাষার সুর শুনে এগিয়ে এল।

শুনে বলল, ‘বেশ বেশ, তুমি তোমার ভাষা দিবস সেলিব্রেট করছ ভাল। কিন্তু পার্লামেন্টের সামনে তো তুমি বিনা অনুমতিতে কালো পতাকা উড়াতে পার না।’

লুইস পুলিশের সাথে তর্ক করছে, ‘ওয়েল, এট লিস্ট হি ক্যান ক্যারি হিস ন্যশনাল ফ্ল্যাগ।’

জাতীয় পতাকা! রাজীবতো জাতীয় পতাকা আনেনি। হঠাৎ দেখল, সামনের ফোয়ারাটার চারপাশ নানান রঙের চারকোনা কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেখান থেকে একটা সবুজ কাপড় নিয়ে লুইসকে বলল, ‘তোমার কাছে ছুড়ি আছে?’

লুইস ঝোলা থেকে ছুড়ি বের করে দিল। কেউ কিছু বোঝার আগেই রাজীব আঙ্গুলে ছুড়ি চালিয়ে দিল। আর সবুজ কাপড়ের মাঝখানে ঝরে পড়ল ক’ফোঁটা রক্ত।
‘আর ইউ ক্রেইজি?’ – চিৎকার করে পুলিশ এগিয়ে এল।

  • আমি অস্বাভাবিক কিছু করিনি। এটাই আমার পতাকা। আমার দেশের পতাকায় সত্যিই রক্ত লেগে আছে, অনেক রক্ত। রক্ত ছাড়া ওই পতাকা উড়বে না।
    রাজীব আর একটা আঙ্গুলে ছুড়ি চালাতেই পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলল।

‘দিস ম্যান ইস এটেম্পটিং টু কমিট সুইসাইড।’

পুলিশ ভ্যানে তাঁকে তুলে নিয়ে গেল। পুলিশ অফিসার তাঁর কথা শুনছে। অনেক সাংবাদিকও এসে গেছে। ক্যানবেরার শান্ত জীবনে ঘটনাটার মধ্যে বেশ চমক আছে। সব শুনে পুলিশ তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ছেড়ে দিল।

পরদিন অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো পত্রিকায় প্রথম পাতায় রক্তপতাকা হাতে রাজীবের ছবি ছাপা হল, সাথে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। খবরের শিরোনামঃ বাংলা – দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ব্লাড।
রাজীব তাকিয়ে আছে পত্রিকাটার দিকে। ক্যানবেরায় পা দেবার সময় যে অহংকারটা তাঁকে ভেংচি দেয়েছিল, সেটা আবার দেখা যাচ্ছে। এখন সেই অহংকারটা পত্রিকাটার পাতায়। রাজীবকে বলছে, রাজীব, তুমিও একুশ শতকের ভাষাসৈনিক, বাংলার ভাষাযোদ্ধা।

কাটা আঙ্গুল উত্তর দিল, হবে না! এ রকম আগুন রঙের ভাষা যে আর কারো নেই। এমন রক্ততিলকপরা বর্ণমালা ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও খুঁজে পাবেনা যে!