Select Page

ভুল
ভুল নাকি জাতিস্মর।
রূপ পাল্টিয়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে পরিস্থিতির ঠোঁটে উড়ে বেড়ায়। স্কুলে প্রথম মার খেয়েছিলাম ভুল লিখতে ভুল করে। বাঘা স্যারের বেতের শব্দ হাতে লেগেছিল। শব্দটা দেখতাম আর শপথ করে ভুলকে ভাসিয়ে দিতাম পদ্মায়। ভুল অতদূর পদ্মা পর্যন্ত যেতে পারত কিনা জানি না, তবে একটু বাদে বাদে আমার সাথে ঠিকই সাক্ষাৎ করতে ভুলত না।

একদিন জেঠিমা একশত টাকার একখানা কড়কড়ে নোট দিয়ে ক’হালি মুরগীর ডিম আনতে বললেন। এটুকু বললে কোন সমস্যা ছিল না। সাথে যোগ করলেন, ‘দাম কম হলে একটু বেশিই আনিস।’ এটা বলে আমার মাথায় সিদ্ধান্তের ভার তুলে দিলেন।

জেঠিমার একটু বিশেষত্ব ছিল; সারাদিনই ওনার স্বর আমাদের বুঝিয়ে দিত যে – শব্দ সৃষ্টি হতে বাতাসের কম্পন লাগে আর বাতাসের কাঁপুনি বেশি হয়ে গেলে ঝড় ওঠতে পারে। তাই ওনাকে না ঘাটিয়ে চললাম বাজারের দিকে। সাথে সুগ্রীব দোসর পিসতুতো ভাই দীপক।

সেদিন সেই সস্তা যুগকেও সস্তা বানিয়ে ডিম মাত্র ছয় টাকা হালি। নামতার বিদ্যা ঘষে কিলে ফেললাম পুরো সতের হালি ডিম। দোকানদার প্রথমে বাচ্চা ছেলেপেলে দেখে পাত্তাই দিতে চায় নি, পরে অতগুলো কিনছি দেখে বাকবাকুম করতে করতে দুই টাকা ছাড় দিয়ে দিল। আবার চৌত্রিশটা করে ডিম দু’ভাইকে প্লাস্টিকের ঠোঙায় দিয়ে মাথায় হাত-টাত বুলিয়ে বাবা-সোনা বলতে বলতে বিদায় দিল।

খাতির-টাতির পেয়ে আনন্দের পিঠ চাপড়িয়ে আমরা ছুটছি বাড়ির দিকে। পথে বুড়ো করিম শেখের সাথে দেখা – ‘তোদের বাড়িতে কি ডিম দিয়ে মচ্ছব হবে রে?’

উত্তর শুনে শেখ চাচা একেবারে থ – ‘এ্যাঁ, তোর জেঠা-জেঠি দুই জনের সংসার; জেঠি তো আবার নিরামিষ খাচ্ছে ইদানিং, তো জেঠার একলার জন্য এত্ত ডিম! নিশ্চয়ই মচ্ছব হবে রে।’

এবার দুজন মিলে ভাবছি – এম্মা! জেঠিমা দাম কম হলে বেশি কিনতে বলেছেন – তাই বলে আটষট্টিটা ডিম! জেঠামশাই একা ক’দিনে খাবেন এত্তগুলো। সেসময় ইলেক্ট্রিসিটি মাত্র দু’একটা গ্রামের পথে হাঁটতে শুরু করেছে, আমাদের পদ্মাপাড়ের গ্রামের সরু পথকে তখনও খুঁজে পায়নি ফ্রিজ। তাহলে ভুলকে যে পদ্মায় ভেসে যেতে বলেছিলাম – সে আমার কথা শোনেনি। দুভাই মিলে চিন্তা করছি আর জেঠিমার বাজখাই গলা ভেসে উঠছে।

দীপক বলল, ‘অত্ত ডিম নিয়ে বাসায় গেলে আমাদেরকে আস্ত রাখবে না রে। চল কিছু ডিম বিক্রি করি।’ বাহ, বিপদের সময় দীপকের মাথা ঘষলেই বুদ্ধি জ্বলে, বড়ই কাজের এই ছেলেটা।

বাজারে ফিরে দেখি, বাজার ভেঙে যায় যায়, কেনার মত তেমন কেউ নেই। আমরা এক কোনায় দাড়িয়ে ডিম নিয়ে। অবস্থা দেখে সেই ডিম বিক্রেতা যে আমাদের কাছে বিক্রি করেছিল, হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। না, লোকটার দয়া-মায়া আছে – ‘তা বেশ, তোমরা অত বিপদে পড়েছ, কিছু ডিম আমি কিনতেই পারি, তবে এখন কিন্তু তিন টাকা হালি পাবে।’

বলে কি! আধা ঘণ্টায় অর্ধেক দাম? অনেক অনুনয় বিনয় করে চার টাকা দাম ঠিক করে আমরা বারো হালি ডিম বিক্রি করলাম। নেট লস চব্বিশ টাকা। বাড়ি ফিরে আমার আর দীপকের জমানো টিফিনের টাকা যোগ করে হল চৌদ্দ টাকা – তাও দশ টাকা কম। এই ঘোর বিপদে আবার দীপকের মাথায় বুদ্ধি হেসে ওঠল – ‘এ্যারে, আমরা ডিম কিনেছি পাঁচ হালি, তো ছয় টাকা না বলে প্রতি হালি আট টাকা করে বললেই তো মিটে গেল।’

আহা, ওর মত একজন সুগ্রীব ছিল বলেই এবারও রক্ষা পেলাম। শুধু দুজনের জমানো টাকাগুলোতে ডিমওয়ালার পকেট ঢোল হয়ে গেল।

মনে অনেক কষ্ট নিয়ে দুভাই বিকেলে ঘরে বসেছিলাম, খেলার মাঠের হাক-ডাক সেদিন আমাদের টানতে পারেনি। হঠাৎ হামিদ কাকার গলা। বাবাকে ডাকছেন, ‘কি হে, আমাদের একবার না জানিয়েই মুরগীর ফার্ম করলে? তোমার ছেলেকে দেখলাম বাজারে ডিম বিক্রি করছে।’

আহা, এত কিছু করেও আমাদের শেষ রক্ষা হল না। বাবা-মার কাছে সব কিছু খুলে গেল।

বাবা হাঁকলেন, ‘কিনেছিলি যখন বাড়ী আনলেই হত; তোর জেঠামশায় না খাবে, আমরা খেতাম।’ তাঁর ঠোঁটের কোনে হাসি। জেঠিমাও দেখি আঁচলে মুখে ঢেকে বাবার সাথে হাসছেন। হায়, যার জন্য করি চুরি ……

এভাবে ভুলকে যতই তাড়াতে চেয়েছি – ততই কাছে এসেছে। স্কুলের পরীক্ষার পর ঢাকায় চলে আসার সময় পদ্মার পাড়ে এসে ভুলকে বললাম, তোকে তো অনেক বার পদ্মায় ভেসে যেতে বলেছি; তুই যাসনি, এবার আমিই যাচ্ছি; তুই থাক এই কীর্তিনাশার তীরে। ভুল কী ভেবে চোখ মারল – ওই চোখমারার পাসওয়ার্ড আমার জানা ছিল না। আমি লঞ্চে চড়ে ঢাকায় উচ্চশিক্ষার উঠানে গেলাম। অনেক নতুন বন্ধু।

একদিন ভার্সিটির হলে একজন জানাল, আমরা বাপের টাকা খর্চা করে পড়াশুনার শ্রাদ্ধ করছি, আর ওরা এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) ব্যবসা করে হাজার হাজার টাকা পকেটে পুরছে; বাবা-মাকে লাখ টাকার এলসিডি টিভি কিনে দিচ্ছে। বিষয়টা একেবারেই পরিষ্কার – গাছ লাগানো হচ্ছে বান্দরবনের বিশাল পাহাড়ের পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে, অল্প টাকা বিনিয়োগ করলেই আমি কিছুদিন পরে লাখ টাকার গাছের মালিক। তাঁর চেয়েও বড় কথা – যদি দুইজনের কাছে বিক্রি করতে পারি, তাহলেই কমিশন; তাঁরা আবার চারজনের কাছে বিক্রি করলেই আরো বেশি কমিশন। এভাবে চক্রবৃদ্ধিতে লাখপতি হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। আহা, কিনে ফেললাম গাছ।

কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে দেখি – সেই ডিম বিক্রির চেয়েও ভয়ানক অবস্থা, কেউই কিনবে না। যাকগে কমিশনের চিন্তা বাদ – গাছ তো আছে।

আহা, কদিন পরেই খবরের কাগজে বেরুল – সেই এমএলএম কোম্পানির মালিকরা প্রতারণার দায়ে জেলে গিয়েছেন। হুম, ভুল তাহলে কীর্তিনাশার তীরে বসে থাকেনি, এখানেও তাঁর গান শুনলাম।

এরপর প্রেম – কিন্তু শুরু থেকেই প্রেমিকার কাছে আমার সবই ভুল। প্রথম চিঠির বানান ভুল; দিয়েছি ফুল – তাও নাকি ভুল। এমন ভুল লোকের সাথে প্রেম করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে প্রেমিকা একদিন ভুল করে আমাকেই বিয়ে করে ফেলল। সে যে কী মারাত্মক ভুল সে কথা না হয় অন্যদিন হবে।

ওই ভুল প্রেমটা বাদ দিলে ছোট বেলা থেকেই মেয়েদের কাছে আমার একটাই ভাবমূর্তি ঘোরাঘুরি করে – বড়ভাই ইমেজ। দুদিন আগে রাখী পূর্ণিমার দিন ফেইসবুকের ইনবক্সে বড় ভাইয়ের জন্য সুন্দর সুন্দর ছবি ও শুভবার্তা আসতে থাকল। প্রিয় বোনদের মিষ্টি মিষ্টি শুভকামনায় ধন্য হতে থাকলাম। হঠাৎ একটা মেসেজে দেখি, শুভকামনার সাথে গোলগাল চেহারার একটা মেয়ের ছবি – পরিধানে বস্ত্র নাই বললেই চলে; তবে দেখেই বোঝা যায় কোন বলিউড গার্ল। যে পাঠিয়েছে তাঁর ইমেজও মার্জিত। আবার ছবির সাথে বড় ভাইকে রাখী পরানোর শুভবার্তা। ঠিক মিলছে না – কেমনে কী মমিন!

কিছুক্ষণ ভেবে এক বলিউড বিশেষজ্ঞ বন্ধুকে ছবিটা দেখাতেই – ‘আরে, এতো রাখী সাওয়ান্ত, বলিউডের বিখ্যাত আইটেম গার্ল।’ নামটা আবার শুনলাম- রাখী সাওয়ান্ত! আহা, ওই বেচারী বোনটা নিশ্চয়ই গুগুলে ‘রাখী’ লিখে সার্চ দিয়ে একটা ছবি পাঠাতে অন্যটা পাঠিয়ে দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ সম্প্রীতির নজির হিসেবে মসজিদের ইমামকে রাখী পরিয়েছিলেন। সেই পবিত্র রাখী বন্ধনের উপহার পেলাম কিনা বসনহীনা বলিউড কন্যা! এখন এ রাখী আমি কোথায় রাখি?

ভুলের অভিযোজন ক্ষমতাও অসামান্য, বংশ পরম্পরায় সে অভিযোজিত হয়। হয়ত এজন্যেই দাদু শেষ জীবনে বলতেন, ‘আমার চুল আর ভুলের মিল এইখানে যে – এখন দুটোকেই গুনতে সমান সময় লাগে। আর পার্থক্য এইখানে যে – একটা দিনে দিনে কমল, অন্যটা বাড়ল; একটা যৌবন হারিয়ে বৈধব্যের সজ্জা ধরল, অন্যটা বর্ণচোরা – দাঁড়ি গোঁফ একই রয়ে গেল।’

আমিও টের পাচ্ছি, দুঃখজীবী প্রানী – মানুষের চুল আর ভুল সংখ্যায় ব্যস্তানুপাতিক।