Select Page

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ। ছেলেটার একলা বিকেল। আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশটা তাঁর মনের ছায়া। মনের মতই আকাশও ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। ছেলেটা কাঁদলে আকাশও কাঁদে।

প্রতিটি মানুষই আসলে এক একটা আকাশ। আকাশটা একটু মেঘ-ছোঁয়া – নীলচে। নীলের উপর ভাসে টলটলে পদ্মপাতা। পাতার উপর এক চিমটি ভালোবাসা আর তিন চিমটি কান্না।

থাক এসব দার্শনিক আলাপ। ছেলেটার কথা বলি। ও বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিল। সেই আশায় ভার্সিটিতে একটা এঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ভার্সিটিতে যাবার কিছুদিন পর হতেই ওর মন খারাপ। একলা বিকেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে – আমি কেন এখানে এসেছি? কিসের জন্য এতদূরে পড়ে আছি মা বাবা সব ছেড়ে? সেই ছোট্টবেলা থেকেই মনে ছিলো আশা – একদিন বিজ্ঞানী হবে। বড়ুই গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে ঠাকুরমা ছড়া বলতেন –
‘কাগজ দিয়ে উড়োজাহাজ বানাই কত রোজ
তুই মা শুধু রাঁধতে জানিস রাখিস কি তার খোঁজ?
…………………………………………
মাথা আমার মন্দ নয়, এবার দেখিস ঠিক
তোর ছেলে মা হয়ে যাবে বড় বৈজ্ঞানিক।’

ঠাকুরমার বৈজ্ঞানিক ভাবনা তখন একটু একটু করে নাড়া দিচ্ছিলো ওর কুট্টি মনে। এরপর স্কুল। স্কুলে সে খুবই ভালো। কয়েক জেনারেশনের মধ্যে নাকি তাঁর মতো ভালো ছাত্র আর এই স্কুলে আসে নি। শিক্ষকরা ভীষণ পছন্দ করেন। মাঝে মাঝে বলেন, তুই বিজ্ঞানী হবি। হুম, তাইলে বিজ্ঞানী হওয়া খুব কঠিন কিছু না, চাইলে মনে হয় হওয়াই যায়। এই সুন্দর ভাবনাটা নিয়েই ও ভার্সিটিতে এসেছে। মন জুড়ে আশা – একদিন সে বিজ্ঞানী হবে।
.
কিন্তু ভার্সিটিতে তো কেউ বিজ্ঞানী হবার আলাপ করে না। এখানে শুধু চাকরির কথা। আর চাকরি তো সোনার হরিণ। চাকরি মানে তো হতাশা। এই বাজারে কি ভালো চাকরি মিলে?

ভার্সিটির বড় ভাই আর আপুরা যেন এক আজব চিজ। শতকরা নব্বই ভাগই ভীষণ রকমের হতাশ। একটা বড় অংশ পড়াশুনাই করে না। তাঁরা চান্স পেলেই বলে – পড়ে হইব টা কী? পাশ করে চাকরি পাইবা? এই সেমিস্টারে তো ল্যাপলাস ট্রান্সফর্ম শিখলা – এইটা কোনোদিন কামে লাগব? দুই দিন পরে এইডা খাইবা না মাথায় দিবা? সে জানেই না – এঞ্জিনিয়ারিং এ ল্যাপলাস ট্রান্সফর্ম এর কাজ কি? কিন্তু এইটা দিয়া যে চাকরি পাওয়া যাবে না – সেটা প্রচার করে বিরাট বিশেষজ্ঞ হয়ে যায়।

একটু একটু করে ছেলেটার বিশ্বাস ভাঙতে থাকে। বিজ্ঞানী হবার আশাও একটু একটু করে কমে। সবাই খালি চাকরি চাকরি করছে। কেউ গবেষণার কথা বলে না। তাঁরও মনে হয় এখন থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা করা উচিত।

কয়েক জন সিনিয়র আপু চান্স পেলেই আঁতেল হবার ভাব ধরে। জুনিয়র দেখলেই আবার এই আঁতেল সম্প্রদায়ের আঁতলামি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ধুর, এইটা পারো না? তোমাদের ব্যাচটা এক্কেরে যাচ্ছেতাই। কী সব প্রোডাক্ট যে আমাদের ভার্সিটিতে আসতেছে? তুমি তো ডিপার্টমেন্টের মান-সম্মান ডুবাইবা। শিখো, না পারলে বড়দের কাছ থেক শিখতে লজ্জা নেই।

এসব শুনে ছেলেটার কনফিডেন্স আরো কমে যায়। সে এদের চেয়ে কত কম জানে! এতো কম জেনে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব?
কয়েকজন সহপাঠী বলছে – তাঁরা বিদেশে চলে যাবে। এদেশে লেখাপড়া করে কোন ভবিষ্যত নেই। তাঁদের বাবার অনেক টাকা। বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছু শিখবে।

তাহলে? তাঁরও কি বিদেশ চলে যাবার চেষ্টা করা উচিত। না, অত টাকা সে কোথায় পাবে? সেটা সম্ভব নয়।

পথের দিশা খুঁজতে ছেলেটা দু-এক জন শিক্ষকের দরজায় কড়া নাড়ে। শিক্ষক সাহেব ব্যস্ত মানুষ। তাঁর সময় নেই। বিজ্ঞানী হবার রাস্তা বলে দেবার জন্য তাঁর আশে-পাশে কেউ নেই।একদিন শুনলো – তাঁর কয়েকজন সহপাঠী এখন থেকেই চাকরির পড়া করে। তাঁরা বাজারের সব গাইড মুখস্ত করে ফেলছে। চাকরির বাজারে তাঁরাই হবে প্রধান সিপাই।

তাহলে? তাঁর কি হবে? এতোগুলো মানুষ কি ভুল করছে? এদের কেউ রাস্তায় মাস্তি করছে, তাঁরা বলছে – লেখাপড়া করে কী হবে? কেউ কেউ বিদেশে চলে যাবে। কিছু আঁতেল বলছে – তাঁকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।

না, না, কিছু তো হতেই হবে। তাহলে যারা চাকরির পড়া করছে, ওরাই তো মন্দের ভালো। ওদের মতো হওয়া উচিত। সেদিন বিকেলে ছেলেটা এক সেট চাকরির গাইড কিনে আনলো।
..
সে এখন আর বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখে না। গবেষক হবার স্বপ্ন দেখে না। পাশ করে একটা চাকরি পেতে হবে – এটাই এখন তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তাঁর সাবজেক্টের পটেনশিয়ান দিকগুলোর খোঁজ সে পায়নি। না, ভুল বললাম। সেই খোঁজ তাঁকে দেয়া হয়নি। তাই আজ শুধু একটা ভালো চাকরিকেই সে স্বপ্ন বলে ধরে নিয়েছে। সে ভুলে গেছে – একদিন বিজ্ঞানী হতে চেয়েই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। যে সম্ভাবনার পাখা তাঁর ঠাকুরমা সযত্নে তৈরি করেছিলো, পরিবেশ তাঁকে একটু একটু করে ছেটে দিয়েছে। বড়ুই তলার সেই কুট্টি বিজ্ঞানী হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল পথের মাঝে।
.
একদিন তাঁর স্বপ্ন হিমালয় ছুঁয়েছিলো। আজ সেটা নীলগিরি পাহাড়ে যেতেই ভয় পায়। এখন তাঁর সীমানা আকাশ নয় – টাই পরে অফিসে যাওয়া পর্যন্ত। তবুও মাঝে মাঝে একলা বিকেলে মাথার উপর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলে, ও শুনতে পায় – আকাশটা ফিস ফিস করে বলছে-
‘ছেলেটা বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলো’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………