Select Page

১৯৩৮ সাল। ইউরোপে প্রবল পরাক্রম দেখাতে শুরু করেছেন হিটলার। কিছুদিন আগে অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে একীভূত করেছেন। এবারের টার্গেট চেকোস্লোভাকিয়া। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর সুডেটল্যান্ড নামে একটা ভূখণ্ড চেকোশ্লোভাকিয়াকে দিয়ে দেয়া হয়। এখন হিটলারের সেটি ফেরত চাই। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে ফ্রান্স আর ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। তাঁরা চেকোস্লোভাকিয়ার সামরিক মিত্র। সে অনুযায়ী কথা ছিল – চেকরা আক্রান্ত হলে ব্রিটেন আর ফ্রান্স তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু হিটলারের হম্বিতম্বিতে বেশ ভয় পেয়ে গেছে ব্রিটেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন হিটলারের সাথে যুদ্ধ চান না। ইংলিশরা এখনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তাই তিনি আপোষের নীতি নিয়েছেন। হিটলারকে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে যা চায় তাই দিয়ে হলেও আপাতত শান্ত করবেন। তাঁর এই আপোষের নীতির গালভরা নাম ‘পলিসি অফ এপিজমেন্ট’ (Policy of Appeasement).

তো আলোচনা শুরু হলো জার্মানির মিউনিখ শহরে। হিটলারের চাই চেকোস্লোভাকিয়া। চেম্বারলেইনের চাই শান্তিচুক্তি। তিনি ভাবলেন – হিটলার তো আমার নিজের কিছু চাইছে না। সে চাইছে চেকোস্লোভাকিয়ার জিনিস। সেটা দিয়ে দিলে যদি জার্মানির সাথে ব্রিটেনের শান্তিচুক্তি হয় – তাতে আমার সমস্যা কোথায়? তিনি হাসিমুখে হিটলারকে দিয়ে দিলেন চেকোস্লোভাকিয়া। চেক বা স্লোভাক নেতাদের সাথে আলাপ পর্যন্ত করলেন না। চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষের আবার কি কথা? এখন দরকার বিশ্বশান্তি। তাতে ছোটমোট চেক বা স্লোভাক জনগণের কথা মনে রাখলে চলবে? শান্তির জন্য অমন কত কিছু কুরবানি দিতে হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর মিস্টার চেম্বারলেইন হিটলারের সাথে সই করলেন মিউনিখ চুক্তি। চেকোস্লোভাকিরার সুডেটল্যান্ড জার্মানিকে দিয়ে দেয়া হলো। এক জনের দেশ অন্যকে দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তি। অদ্ভুত বাহারি ‘পলিসি অফ এপিজমেন্ট’ !!

এই রকম হাস্যকর মিউনিখ চুক্তি করে তাঁরা দুইজন হাসিমুখে সভাকক্ষের বাইরে এলেন। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল। চেম্বারলিনের হাতে ছিল একটা ব্রিটিশ ট্রেডমার্ক ছাতা। হিটলার বললেন, মিস্টার চেম্বারলেইন, আমাকে ছাতাটা একটু দিবেন?

রে রে করে উঠলেন চেম্বারলেইন –‘না, না মিস্টার হিটলার। সেটা কী করে হয়! ছাতাটা তো আমার নিজের। এটা দেয়া যায় নাকি?’ মনে মনে বললেন, এটা তো চেকোস্লোভাকিয়া নয়।

গল্পের ছাতার অংশটা কিংবদন্তী। মজা করে বানানো। বাকি অংশ ইতিহাসের সত্যি। চেম্বারলিনের এই হাস্যকর রকমের ‘পলিসি অফ এপিজমেন্ট’ই হিটলারকে সে সময় আরো উদ্ধত করেছে। সে ব্রিটেন আর ফ্রান্সকে অনেক বেশি দুর্বল ভেবেছে। চেম্বারলেইন ভেবেছিলেন, সুডেটল্যান্ড জার্মানিকে দিয়ে দিলে হিটিলার খুশি মনে বসে থাকবেন। মিউনিখ চুক্তি করে লন্ডনে ফিরে সগর্বে বললেন, আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছি। মিউনিখ চুক্তি হলো – “Peace with honor, peace for our time”. কিন্তু না, তাঁর প্রত্যাশার শান্তি আসেনি। কিছুদিন পরই শুধু সুডেটল্যান্ড নয়, পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে জার্মানি। এরপর একে একে আক্রমণ করেছে পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্সকে। চলে এসেছে ব্রিটেনের দুয়ারে। চেম্বারলেইনের শান্তির আশা চলে গেছে সুদূরে। যে যুদ্ধ না করারে জন্য তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার জনগণকে বঞ্চিত করেছেন, সেই যুদ্ধ আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। অন্যায়ের মাধ্যমে শান্তির আনার তাঁর ভুল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মারাত্মকভাবে ফেইল করেছে তাঁর ‘আপোষ নীতি’। ইংলিশ জনগণের কাছে তিনি একজন দুর্বল নেতা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন উইন্সটন চার্চিলের কাছে। চার্চিল বললেন, মিস্টার চেম্বারলেইন যুদ্ধ চাননি, কিন্তু তাঁর আপোষ ব্রিটেনকে অসম্মান আর যুদ্ধ দুটোর মধ্যেই এনে ফেলেছে। চেক আর স্লোভাক জনগণকে ঠকানোর ফলাফল মিস্টার চেম্বারলেইন ভালোই পেয়েছিলেন। সেখানের মানুষ এখনো ভোলেনি সেই মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতা (Munich Betrayal).

সেই থেকে মিউনিখ নিয়ে বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘুরে ফিরেই এসেছে। আমেরিকার পণ্ডিতরা এটা নিয়ে একটা নতুন শব্দ বানিয়ে ফেললেন – Miniching (মিউনিখিং)। শান্তি প্রত্যাশী নেতাদের জন্য দীর্ঘদিন মিউনিখিং ছিলো একটা আতঙ্ক – একটা ভীষণ নেগেটিভ শব্দ। যখনই কোন নেতা আপোষের মাধ্যমে শান্তি আনতে চান, তাঁকেই বলা হতো, ‘জনাব – মিউনিখিং করছেন?’ স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সাহেবরা তাঁদের শক্ত নীতি মানুষের কাছে মার্কেটিং করার জন্য উঠতে বসতে মিউনিখিং এর কথা বলতেন। আবার প্রেসিডেন্টের কোন একটু আপোষ দেখলেই, বিরোধীরা বলে উঠত, এ ব্যাটা একটা চেম্বারলেইন।

যে কোন সমাজতান্ত্রিক বিজয়ই তখন আমেরিকার পণ্ডিতদের চোখে মিউনিখিং। ১৯৪৯ সালে গণচীনের আবির্ভাব, ১৯৫০ এ কোরিয়ান যুদ্ধ সবই তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন আপোষের নীতি হিসেবে। এমনকি ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধকে আমেরিকার যুদ্ধ বানিয়ে ফেলার পলিসি নিলেন, তখন জনগণকে বললেন, আমরা আপোষ করব না। আমরা আর একটা মিউনিখ কিছুতেই চাই না। সমাজতন্ত্র রুখতে কোন আপোষ নেই। তার সেই এ্যান্টি-আপোষ নীতি ভিয়েতনাম আর আমেরিকাকে পরের এক দশকে কি দিয়েছে – তা সারা পৃথিবী দেখেছে। ঘৃনা নিয়ে দেখেছে। আমেরিকার এ্যান্টি-মিউনিখিং পলিসির মাধ্যমে শান্তি আনার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে ভীষণভাবে।

তাই মিউনিখিং হোক আর শক্ত নীতিই হোক – অন্যায়ের মাধ্যমে শান্তি আনার চেষ্টা বৃথা। তাঁর ফল মানুষকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়। শান্তি চাইলে – সেটা ন্যায়ের পথেই আনতে হবে। যে স্থানের মানুষের জন্য শান্তি, সেখানের মানুষের কথা ভুলে গিয়ে শান্তি আসবে না। শান্তি বড় মানুষপ্রিয় জিনিস। মানুষকে ভুলে গেলে, শান্তিও আপনাকে ভুলে যাবে।

© সুজন দেবনাথ