Select Page

কবি সাহিত্যিকদের আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না।
আমার বড় মামা একজন নামকরা সাহিত্যিক। তাঁকে দেখে অন্তত এইটুকু বুঝেছি যে, লেখকরা যা লিখেন, সেটা তাঁরা নিজেরাই বিশ্বাস করেন না। আর যদি বিশ্বাসও করেন, সে অনুযায়ী কখনওই কাজ করেন না। তাই এদের থেকে আমি যথাসাধ্য দূরে থাকি। মাঝে মাঝে মনে হয় – ট্রাকের মত করে আমার পিঠেও লিখে রাখি – কবি-লেখকগণ, একশো হাত দূরে থাকুন।

তবে এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম শিমুল চৌধুরী। তাঁকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। অত্যন্ত বিখ্যাত লোক এই শিমুল সাহেব। তাঁকে একজন স্টার লেখক বলা চলে। কিন্তু নিজের জ্ঞান নিয়ে তাঁর কোন গর্ব নেই। অকারণেও তাঁর মুখে নির্মল হাসি লেগে থাকে।

এই শিমুল চৌধুরী আমাকে ডেকেছেন। আমি এখন শিমুল চৌধুরীর বাসায়। শুধু বাসায়ই নয়, একেবারে তাঁর লেখার ঘরে। এই ঘরে ঢুকেই আমি অবাক হয়েছি। ঘর তো নয়, যেন একটা জাদুঘর। তাও আবার সাধারণ জাদুঘর নয় – চুড়ির জাদুঘর। কাচের বড় বড় বাক্সের ভেতর স্টিলের স্ট্যান্ডে ঝুলছে নানান রকমের চুড়ি। পৃথিবীতে যে এত ধরনের চুড়ি আছে সেটা এখানে না এলে জানাই হতো না।

লেখক সাহেব অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছেন একটা চুড়িদানির দিকে। হঠাৎ বললেন,
আজ আমার একটা বিশেষ দিন। প্রতি বছর এই দিনে আমি একজন মাত্র মানুষকে ডাকি আমার একেবারে নিজের গল্প বলার জন্য। এবছর তোমাকে ডেকেছি। শর্ত হচ্ছে তুমি দুই কানে শুনবে। কিন্তু তিন কান করা যাবে না। অন্তত আমার মৃত্যুর আগে নয়।

আমি সম্মতির মাথা ঝাঁকালাম। তিনি বলতে শুরু করলেন –
তখন আমার বয়স পঁচিশ বছর। আমার মাথায় একটা উদ্ভত শখ দেখা দিল। গরিবের ঘোড়া রোগ শুনেছ। আমার হল একেবারে গরীবের হাতি রোগ। শখটা হল – আমি সারা পৃথিবী ভ্রমণ করব আর সেই ঘুরে বেড়ানোর গল্প মানুষদের কাছে ক্যানভাস করে বলব। এই ভ্রমণ গল্পের নায়ক থাকব আমি একা আর নায়িকা হবে অসংখ্য।
আমার জন্য এই শখ পূরণ করা অসম্ভব। এই শখের তোলা আশি টাকা না, আশি হাজার টাকাও না, আশি হাজার ডলারের কাছাকাছি। এই পরিমাণ টাকার কথা আমার কল্পনাতেও কোনদিন আসে নি। আমি একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাও এখনকার মধ্যবিত্ত না, সেই আশি-নব্বই দশকের মধ্যবিত্ত – যাঁদের আসলেই নুন আনতে পান্তা না ফুরালেও ডাল ফুরিয়ে যেত।

তবু এই মারাত্মক ব্যয়বহুল শখ আর আমার অতি নিম্ন আয়ের মধ্যে সমন্বয় করে শখের কিছু অংশ পূরণ করার একটা উপায় বের করে ফেললাম। উপায়টাও শখের মতই উদ্ভট। প্রতিদিন সকালে উঠে ভাবি – আমি একটা নতুন দেশ ভ্রমণে গেছি। সারাদিন সেই নতুন দেশ নিয়ে পড়াশুনা করি আর বিকেলে রাস্তার কোনায় লোক জড়ো করে সেই দেশ ভ্রমণের গল্প বলি। সেই গল্পের নায়ক আমি আর নায়িকা যেখানে ভ্রমণে গিয়েছি সেখানকার কোন এক অপ্সরী।

যেমন আমি যদি স্পেনিশ ভাষায় কথা বলে এমন কোন দেশ ভ্রমনে যাই, তাহলে যে গল্প মানুষের কাছে বলি তাতে আমি গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ আর গল্পের নায়িকা অবশ্যই রাণী ইসাবেলা। এদের দুজনের বয়স, স্থান, কাল যাই হোক না কেন, আমার সাথে ইসাবেলার দেখা হবেই। আবার আর্জেন্টিনা ভ্রমণের গল্পে আমি হয়ে যাই চে গুয়েভারা। আর সেই গল্পে বিপ্লবী হয়েও কী ভেবে যেন চে আয়োজন করে বসে একটা শান্তি সম্মেলনের। অতি আশ্চর্যজনকভাবে সেই সম্মেলনে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সাথে আলোচনায় বসিয়ে দেব কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। সেখানে আমি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে হঠাৎ বিজয়া নামে ডাকলে তিনি চমকে উঠবেন। কেননা তাঁকে এই নামে ডাকত একমাত্র রবীন্দ্রনাথ। তখন যদি বুড়ো রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তে ওকাম্পো আমাকে পছন্দ করে ফেলে, তাতেও কিন্তু মাইন্ড করা যাবে না।

আমার এই উদ্ভট ভ্রমণগল্প বলার ফল হল দুটো – কয়েকদিনের মধ্যে আমার পাগল নামটা মোটামুটি ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তায় গল্প বলতে গেলে লোকে দুয়ো ধ্বনি দেয়। অল্প দিনেই আমার সত্যিকার শুভাকাংখী ও বন্ধুরা সব দূরে চলে গেল। আর একদিন অফিসে গিয়ে শুনি আমার অতি অল্প বেতনের চাকরিটাও আর নেই। চাকরি চলে যাওয়াতে অবশ্য আমার তেমন দুঃখ হল না। বরং অফুরন্ত সময় পাওয়া গেল বিভিন্ন দেশ নিয়ে পড়াশুনা করার। কিন্তু বন্ধুহীন হওয়ায় আমার ভ্রমণের গল্প বলার জন্য কোন লোক থাকল না।

গল্প বলার লোক না পেয়ে এক একদিন হাঁপিয়ে উঠতাম। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নাকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা অভ্যাস করতেন। আমিও আয়নার সামনে গল্প বলতে শুরু করলাম। তাতে কোন লাভ হল না। নিজেকে মনে হত একাকী দ্বীপের রবিনসনক্রুশো। শুধু পার্থক্য হল রবিনসনক্রুশোর কোন আয়না ছিল না, আমার একটা আয়না আছে।

এরকম যখন মনের অবস্থা, তখন একদিন দেখা হল চুড়িকন্যার সাথে। চুড়িকন্যা আমার মামাতো বোন তুলির বান্ধবী। একদিন বিকেলে মামার বাসায় তুলিকে বলছিলাম ইতালির ভেনিস শহরের গল্প –

‘শোন তুলি, আমি সেবার নামলাম ইটালির ভেনিস শহরে। শহর বলা ভুল হবে, পুরো শহরটাই আসলে বন্দর। এখানে সেখানে ছোট বড় নৌকা। আমি ভাবতেছিলাম, এরকম নৌকার মেলা যেন আমি বাংলাদেশে কোথায় দেখেছি। কোথায় হতে পারে বলতো?’
তুলি বলল, ‘জানি না।’

‘বাংলাদেশের ভূগোল সম্বন্ধে তো দেখছি তোর অবস্থা খুবই করুণ। শোন, ভেনিসের নৌকা দেখে আমার মনে পড়ল বরিশালের কথা। ছোট্টবেলায় একবার মামার সাথে গিয়েছিলাম বরিশাল। কীর্তনখোলা নদীর তীরে ছোট বড় নানান ডিজাইনের নৌকা। এইজন্যেই বরিশালকে বলত প্রাচ্যের ভেনিস।’

তুলি বিরক্ত হয়ে উঠল, ‘কে শুনতে চেয়েছে তোমার প্রাচ্যের ভেনিসের কথা? পাশ্চাত্যের ভেনিসে কি হল বলো।‘

বলছি তো, একটু ধৈর্য্য ধর। আমি ভেনিসের রাস্তায় হাঁটছিলাম। রাস্তা খুবই খানাখন্দে ভরা। নিচু শহর, অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। সেখানে রাস্তা ভাল রাখা খুব কঠিন। উঁচুনিচুতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক বুড়োর সাথে ধাক্কা লাগল। বুড়োকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছিল। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি – আরে এ তো শেক্সপিয়র। তিনি ভেনিস এসেছিলেন গল্প লেখার প্লট খুঁজতে।

হঠাৎ পাশের রুম থেকে একটা রিনরিনে গলায় একটা মেয়েলি স্বর ভেসে এল, আপনার সাথে ভেনিসে শেক্সপিয়রের দেখা হয়ে গেল?
আমি জানতাম না যে পাশের রুমে বসে আর একটি মেয়ে আমার গল্প শুনছে। তুলি যে তাঁর পাগল মামাতো ভাইয়ের গল্প শোনাতে তাঁর বান্ধবীকে ডেকে এনেছে, সে কথা আমাকে বলেনি।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলাম, হুম, ঠিক তাই, শেক্সপিয়ার হাঁটছিলেন উদভ্রান্তের মত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমরা দু’জন থামলাম এক আমবাগানে। সেই আমবাগানে দাঁড়িয়ে আমি উঁকি দিলাম পাশের এক সুন্দরী তরুণীর দিকে। আর শেক্সপিয়ার পেয়ে গেলেন গল্পের প্লট। আমবাগানে আমার সেই উঁকি দেখেই তিনি পেলেন চরিত্র রোমিও আর পাশের বাড়ির তরুণীটিই হল জুলিয়েট।
এবার পাশের রুম থেকে মেয়েটি সামনে এল। সাথে এল কেমন একটা চুড়ির শব্দ। বলল, শেক্সপিয়র বুঝি ভেনিস শহরে রোমিও-জুলিয়েটের দেখা পেয়ে গেলেন?’
হুম।
আপনার মনে হয় একটু ভুল হচ্ছে। আপনি হয়তো বলতে ভুলে গেছেন যে, তখন আপনি আর শেক্সপিয়র ভেনিস থেকে রোম শহরে গিয়েছিলেন। রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনী রোম শহরে, ভেনিসে নয়। ভেনিসের সাথে একটু মিলতে পারে তাঁর আরেক গল্পের – ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’, কখনওই ‘রোমিও জুলিয়েট’ নয়।
আমি চূড়ান্তভাবে ধরা খেয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, রোমেই গিয়েছিলাম।

কিভাবে গিয়েছিলেন? রিক্সায় করে? কত ভাড়া নিয়েছিল রিক্সায়?
সতের টাকা।
টাকা? ইতালীতে গিয়ে আপনি রিক্সায় চড়লেন। আবার ভাড়া দিলেন টাকায়? আপনি মনে হয় আবার ভুলে গেছেন। আপনি আসলে ভেনিস থেকে গিয়েছিলেন ভেরোনা শহরে। ভেরোনা হল ভেনিস থেকে ১১৫ কিমি দূরের শহর। আর রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনী এই ভেরনা শহরে। একটু আগে রোম বলে আপনাকে বিভ্রান্ত করেছি। আর আসলে আপনি ভাড়া দিয়েছিলেন টাকায় না, লিরাতে। রিক্সায় গেলে ভাড়া দিয়েছিলেন সতের লিরা। লিরা হলো ইতালির মুদ্রার নাম, জানেন তো?

আমি নির্বাক। মেয়েটি আবার বলতে লাগল,
আসলে আমার বাবা অনেক বছর ইতালী ছিলেন। সেখানেই আমার জন্ম। আর তাই নাম রেখেছেন লিরা। আমি তুলির বান্ধবী।

এই প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়েটির দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। আমি এমনিতেই সুন্দর মেয়েদের ভীষণ ভয় পাই। তার উপর এই মেয়ে ভয়ংকর রকম বুদ্ধিমতী। রোম শহরের চারপাশ সাতটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই মেয়ের বুদ্ধির উচ্চতা মনে হয় সেই সাত পাহাড়ের চেয়েও বেশি। আমি লিরার সামনে একেবারে শামুকের মত ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল – পরজন্ম থাকলে যেন শামুক হই।

হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে লিরা বলল, আপনি তো ইতালীতে গেলে রোমিও হয়ে যান। তো সেখানে আমবাগানে আপনি উঁকি দিয়ে যে মেয়েটিকে দেখছিলেন, সেই মেয়েটি কি আমার মত? সেই সময় কিন্তু আমি ইতালীতেই ছিলাম।

বলার সময় তাঁর হাতের চুড়িগুলো বেজে উঠল। শহরের মেয়ে হয়েও এত্তগুলো চুড়ি পড়েছে দুই হাতে।

আমি উত্তর করতে পারলাম না। ভাবছিলাম, মেয়েটি এখনও আমাকে নিয়ে বুদ্ধির খেলা খেলে যাচ্ছে কিনা? তবুও মনে মনে বলছিলাম, সেখানে আমি থাকি আর নাই থাকি, তুমি জুলিয়েট হয়ে অবশ্যই ছিলে। শেক্সপিয়র তোমাকেই দেখেছিল। তুমি হলে শেক্সপিয়ারের চুড়িপরা জুলিয়েট। তুমি না থাকলে কোনদিন রোমিও-জুলিয়েট লেখা হত না।
‘কাল আবার আসব আপনার ভ্রমণের গল্প শুনতে। ঠিক এই সময়ে, এখানেই।’

লিরা চলে গেল। আমি শুধু চুড়ির শব্দ শুনছিলাম। ও যা বলছে আমি তাঁর সাথে পরিচিত না। আমার গল্প জোড় করে কাউকে দ্বিতীয়বার শুনাতে পারি না। সেখানে সে নিজেই আবার আসবে আমার গল্প শুনতে। বিশ্বাস হচ্ছিল না। যদি আসে, সে কি জুলিয়েট হয়ে আসবে? ওর প্রতিটা কথা আমার কাছে অবোধ্য মনে হল। শুধু মনে হল চুড়ির শব্দটা আমার চেনা।
এমনকি লিরাকে ভাল করে দেখতেও পারিনি আমি। আর একবার দেখলে চিনব কিনা বুঝতে পারছি না। শুধু চুড়ির শব্দটা মনে আছে। ওই শব্দেই আমি ওকে চিনতে পারব। সেই মুহূর্ত থেকে আমার কাছে ও হয়ে গেল – চুড়িকন্যা।

চুড়িকন্যা পরদিন সত্যি সত্যিই এল। সেই চুড়ির শব্দেই ওকে চিনলাম। আগের দিন আমাকে অপমান করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ‘আমি আসলে আপনার কাছে ভুল গল্প শুনতে চাই না। তাই কাল আঘাত করেছি। আপনি তো নিজের গল্প বলেন, সেখানে কিছু ভুল থাকতে পারে না। নিজের গল্প হবে শুদ্ধ গল্প।’

সেই থেকে চুড়িকন্যার জন্য আমি প্রতিদিন একটা করে ভ্রমণ-গল্প বানাতাম। সেই আমার একমাত্র শ্রোতা। আগের প্রতিটি গল্পে আমার নায়িকা পরিবর্তন হত। কদিন পরে লক্ষ্য করলাম – এখন নায়িকা পরিবর্তন হয় না। এখন প্রতি গল্পে আমার সাথে ভ্রমণে যায় চুড়িপরা একটা মেয়ে।

আমার গল্পে এখন আমরা দু’জন চীনের শিয়ান প্রদেশে মাটির নিচ থেকে বের করা টেরাকোটা সৈনিকদের ছুঁয়ে দেখি। চীনের সম্রাটরা মাটি দিয়ে হাজার হাজার সৈন্য বানিয়েছিলেন। মাটির নিচে সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত সেইসব মাটির সৈনিকরা। তাঁদের হাতে যুদ্ধাস্ত্র। সম্রাটদের বিশ্বাস ছিল – এইসব সৈনিকরা মৃত্যুর পরে তাঁদের রক্ষা করবে। এখন মাটি খনন করে সেইসব সৈন্যদের বের করেছে চীনারা। সেগুলো এখন বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। গল্পে আমি চুড়িকন্যাকে সেইসব সৈন্যদের মত করে সাজাই। সাজাতে গিয়ে সেই সময় চীনা মেয়েরা যুদ্ধ করত কিনা, আর যুদ্ধ করলেও ওড়না পরে যুদ্ধ করা সম্ভব কিনা – এ নিয়ে চুড়িকন্যার সাথে আমার ঝগড়া আর মিটত না।

আবার মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠের পাশের ফিটজরি পার্কে গিয়ে আমরা ক্যাপ্টেন কুকের বাড়ি দেখতাম। সেখানে চুড়িকন্যা আমাকে ক্যাপ্টেন কুকের মত সাজাত। আমি ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ ভাসাতাম অজনা প্রশান্ত সাগরে নতুন কোন দেশ আবিষ্কারের আশায়। চুড়িকন্যা জাহাজঘাটে আমাকে বিদায় দিতে আসত। অশ্রু অমঙ্গলের চিহ্ন জেনেও সে তাঁর চোখ ঢাকতে ভুলে যেত। অনেকদিন পর ক্যাপ্টেনের চিঠি পেত। চিঠিতে ক্যাপ্টেন কুক লিখত, সে নিউ হল্যান্ড নামের একটা দেশ আবিষ্কার করে ফেলেছে পৃথিবীর দক্ষিণ মাথায়। দক্ষিণের সেই নিউ হল্যান্ডকেই এখন আমরা অস্ট্রেলিয়া বলে জানি। সেই চিঠি পড়ে আনন্দে আর একবার কেঁদে ফেলত চুড়িকন্যা।

এভাবে প্রতিদিনের গল্পে দিন কাটছিল। সারা দিনের শেষে বিকেলে চুড়িকন্যা আসবে। তাঁর জন্যই আমার সারাদিনের প্রস্তুতি। শুধু একটা বিষয়ই আমি বুঝতাম না। আমি গল্প বলার সময় চুড়িকন্যা তাঁর দামী মোবাইল ফোনে কি যেন করত। জিজ্ঞেস করলে বলত, আপনার চোখের দিকে তাকালে কথা কানে আসে, কিন্তু আমি শুনতে পাই না।

আমি মনে মনে বলতাম, তুমি আমার চোখের দিকে তাকালে আমিও গল্প বলতে পারি না। তাই এই ভাল, তুমি মোবাইলেই তাকিয়ে থাক। আর আমি তোমার চুড়ির দিকে তাকিয়েই গল্প বলি।

এরমধ্যে চুড়িকন্যাই একদিন একটা চাকরির বিজ্ঞপ্তি নিয়ে এল আমার জন্য। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে এসিট্যান্ট লাইব্রেরিয়ানের পদ। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই চাকরিটা আমার হয়েও গেল। তখন লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ি আর তাঁর জন্য ভ্রমন গল্প বানাই। পরে শুনেছিলাম, চুড়িকন্যার বাবার সুপারিশেই আমার চাকরি হয়েছিল। আমার অবশ্য তাতে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হল – এই চাকরির ব্যাপারে তাঁর বাবা-মা আমার কথা জেনে গেলেন। খোঁজ নিয়ে সহজেই টের পেলেন, প্রতিদিন সে আমার কাছে গল্প শুনতে আসে।

একদিন হঠাৎ চুড়িকন্যা বলল, সে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। তাঁর মামী অসুস্থ। বাবা তাঁকে নিয়ে যাবেন তাঁর মামার বাড়িতে। যাবার আগে সে চুড়ি নিয়ে একটা গল্প শুনতে চায়।
একটু ভেবে আমি শুরু করলাম জয়পুরের নিয়ে গল্প। ভারতের রাজস্থানের জয়পুরের চুড়ি বিখ্যাত। আমরা দুজন ভ্রমণে গিয়েছি সেখানে। দুজন মিলে চুড়ি দেখছি। চুড়িকন্যা যেটা দেখে সেটাই তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু অল্প কটা চুড়ি কিনতেই আমার সব টাকা ফুরিয়ে গেল। আমি চুড়িকন্যাকে সেকথা বুঝতে দিলাম না। গোপনে আমার ঘড়ি আর সোনার আংটি বিক্রি করে তাঁর জন্য চুড়ি কিনলাম।

চুড়িকন্যা আমাকে থামতে বলল। এ গল্প আর শুনবে না সে। তাকিয়ে দেখি তাঁর চোখে জল। ধীরে ধীরে উঠে চলে গেল সে।

শুরু হল আমার অপেক্ষা। চুড়িকন্যা আমাকে কখনও তাঁর ভালোবাসার কথা বলেনি। আমিও গল্পের বাইরে তাঁকে কোনদিন কিছু বলি নি। তবুও মনে হল, সে চলে যাওয়ায় আমার জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে। আমি যেন আবার রবিনসনক্রুশো হয়ে একা দ্বীপে আছি।

এক মাস কেটে গেল। চুড়ি কন্যার কোন খবর নেই। কোনভাবেই তাঁর কোন খোঁজ পেলাম না। মোবাইল অফ, বাসার ঠিকানা জানি না। তুলিও বলতে পারল না ওর বাসার ঠিকানা।
কয়েকমাস পর এক অচেনা ভদ্রলোক এলেন আমার বাসায়। আমার হাতে দিলেন একটা বই আর একটা চিঠি। বিষণ্নভাবে বললেন, আমি লিরার বাবা। লিরা তোমাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে। আগে চিঠিটা পড়ে তারপর বইটা খুলবে।

বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ীতে উঠে পড়লেন।
চুড়িকন্যা লিখেছে –
‘প্রিয় গল্পওয়ালা,
আমি জানি, তুমি আমাকে চুড়িকন্যা বলো। কিন্তু কখনো সরাসরি এই নামে ডাকোনি আমাকে। কেন ডাকোনি? সাহস হয়নি, তাইনা? তোমার মত ভীতু ছেলে আমি জীবনেও দেখিনি। তুমি কি জানো – একবার তোমার মুখে এই নামটা শুনতে কী ভীষণ ইচ্ছা করত আমার। নামটা শুনতে আমি কত ছল করেছি তুমি বুঝতেও পারোনি। আমার কেবলই মনে হত – যেদিন তুমি আমাকে এই নামে ডাকবে, সেদিন বুঝি আমি মরেই যাব। কিন্তু কোনদিনই তুমি এই নামে ডাকোনি।

তাই তোমার গল্পে যখন চুড়িকন্যার কথা বলতে, আমি নেচে উঠতাম। আমার ভেতরের আমিই উড়তাম পাখি হয়ে। অবশ্য আমার নাচার কথা তুমি কোনদিন বুঝতেও পারোনি। আসলে তোমাকে বুঝতে দেইনি। কেন দেইনি? কি জানি, মেয়েরা বোধ হয় এমনই হয়।

আমার বাবা আসলে আমাকে বিয়ে দেবার জন্য মামার বাড়ি নিয়ে এসেছে। ছেলে ইতালী থাকে, বাবা-মার খুব পছন্দ। কিন্তু তুমিই বলো গল্পওয়ালা, আমি না তোমার সেই ভুল গল্পের জুলিয়েট? আমার রোমিও কি তুমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে? এখন আমি কি করব, গল্পওয়ালা? আমি কি সত্যি সত্যি জুলিয়েট হয়ে আকাশে চলে যাব? কিন্তু আমার যে এখনও শুধু তোমার আকাশেই আসতে ইচ্ছে করে।

বাবা নিশ্চয়ই তোমাকে একটা বই দিয়েছেন। এটা তোমার লেখা গল্পের বই। অবশ্য তোমার লেখা না বলে তোমার বলা গল্পের বই বলাই ভাল। কারণ গল্পগুলো তোমার বলা, আমার লিখা। একদিন জানতে চেয়েছিলে, তুমি যখন গল্প বলো, আমি তখন মোবাইলে কি করি। আজ বুঝেছ? আমি তখন রেকর্ড করতাম তোমার কথা। আর বাসায় ফিরে লিখে ফেলতাম।
বইয়ের নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে? নাম দিলাম ‘ভুলগল্প’। পছন্দ হয়নি তোমার? না হলেও কিচ্ছু করার নেই। আমার পছন্দই শেষ কথা, তাইনা? মনে আছে তোমার – তুমি আমাকে প্রথম যেদিন গল্প বলেছিলে সেদিন একটা ভুলগল্প বলেছিলে? আমি শুরু করলাম সেই ভুলগল্পটাকে শুদ্ধ করতে। দুদিনেই টের পেলাম, তোমার জীবনটাও আসলে একটা ভুলগল্প। আমার খুব ইচ্ছা হল তোমার জীবনের ভুলগল্পকেও আমি শুদ্ধ করে দেই। ধীরে ধীরে সেই ভুলগল্পের মায়ায় আমি জড়িয়ে গেলাম। একদিন বুঝলাম – এই মায়া থেকে আমার মুক্তি নেই। যাক ওসব কথা।

তুমি কি জান – তুমি পৃথিবীর সেরা একজন গল্পকার। জানি, এটা তুমি জান না। কিন্তু আমি জানি। সেজন্যেই আমি তোমাকে গল্পওয়ালা নামে ডাকছি। বইটা পড়ে ফেল। বিশ্বাস হয় – এইটা তোমার লেখা! এখানে পৃথিবীর কয়েকটি সেরা গল্প আছে। আমি জানি এমন গল্প তুমি প্রতিদিন বানাতে পার। আর থেমো না। আমি তোমার জীবনের ভুলগল্পকে শুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। এটাই সেই উপায়। শুধু ভাববে – তোমার চুড়িকন্যা তোমার সামনে বসে আছে, আর তুমি তাঁকে গল্প শোনাচ্ছ। সেটাই লিখে বই করবে।
তুমি কি জান আমার সবগুলো চুড়ি পরে আমি তোমাকে দেখিয়েছি? আজ থেকে ঠিক দুদিন পরে বাবা তোমার কাছে আমার সবগুলো চুড়ি পাঠিয়ে দেবে। জানি, কেবল তুমিই ওগুলোর যত্ন করবে। আর তোমার প্রতিটা বই প্রকাশের দিন আমার জন্য একটা করে চুড়ি কিনবে। আমি জানি – একদিন তোমার পুরো লেখার ঘর চুড়িতে ভরে যাবে। আর আমি হাসতে থাকব লেখার পাতায় পাতায়। সেদিন তুমি হাসবে না? বলো গল্পওয়ালা, তুমি হাসবে না?


ইতি,
তোমার চুড়িকন্যা
(মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের সপ্তমী তিথি- চাঁদ ডোবার অপেক্ষায়)

কথা শেষ করে শিমুল চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো ওই ঘরে গিয়ে আমরা চা খাই।
আমি বললাম, কিন্তু এখন সেই চুড়িকন্যা কোথায়?
শিমুল সাহেব বললেন, একটু বসো তাহলে। আজ মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষের সপ্তমী তিথি। একটু পরে চুড়িকন্যার বাবা আসবে, একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিয়ে। সেই বৃদ্ধ আজও বিশ্বাস করে – তাঁর মেয়ে এই ঘরেই আছে।

© সুজন দেবনাথ