Select Page

আমি চিরকালই এডভেঞ্চার ভয় পাই। এডভেঞ্চারের কথা পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। লিখতে আরো বেশি ভালো লাগে। কিন্তু নিজে এডভেঞ্চারে বের হবো – নৈব নৈব চ। সুন্দরীরা যেমন দূর থেকেই ভালো, আমার কাছে এডভেঞ্চারও দূর থেকেই মধুর। সেই আমাকে ওরা ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেলো একেবারে গ্রিস পুরাণের পাতালপুরীতে।

জায়গাটা গ্রিসের দক্ষিণ-পশ্চিমে, স্পার্টা থেকে মোটামুটি সত্তর কিলোমিটার দূরে।স্থানীয় নাম ডিরোস গুহা (Diros Cave)। গুহাটি আসলে একটা নদী। কিন্তু নদীটি মাটির উপরে নয়, চলে গেছে পাহাড়ের নিচে।নদী আর নারী নাকি স্বভাবে এক।রামায়নের রাম প্রজাদের খুশি রাখার জন্য সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে বলেছিলেন।তখন স্বামীর প্রতি অভিমানে সীতা পাতালে চলে গিয়েছিলেন।এই নদীটিও মনে হয় নারীর মতো – স্বামীর প্রতি মাইন্ড করে পাতালে ঢুকে গেছে।

নদীর এই অভিমানের কথা তো আমি জানতাম না। তেমন কিছু না জেনেই আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে স্পার্টা হয়ে আইয়োনিয়ান সাগরের পাড়ে ডিরোস গুহার মুখে হাজির হলাম।এখন নৌকায় করে গুহাভ্রমণ।কিন্তু গুহার সামনে একটূ উঁকি দিয়েই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এ যে একেবারে গ্রিক পূরাণের পাতালপুরী।মাটির নিচের অন্ধকারে অদ্ভুত আলো-আঁধারী।তাকালেই গা ছমছম করে।কোন শব্দ নেই, কেউ কিছু বললেই গমগম করে ওঠে।অল্প আলোতে টলটলে স্বচ্ছ নীল জল।বাতাস না থাকায় জল একেবারে স্থির, একটূও কাঁপছে না।মাথার একটু উপরেই একেক রকম দানবের মতো এক একটা পাথর।উপর থেকে হা করে আছে।স্থির জলে সেসব দানবের ছায়া। জলে তাকালেই ভৌতিক মনে হয়।একেবারে রূপকথার মৃত্যুগুহা।

গ্রিক পুরাণে পাতালের দেবতার নাম হেডিস।কেউ মারা গেলে তার আত্মা মাটির নিচে একটা নদীর তীরে যায়।সেখানে নৌকা নিয়ে বসে আছে মাঝি কেরন।কেরন নদীটা পার করে আত্মাকে হেডিসের কাছে পৌঁছে দিলে আত্মা মুক্তি পাবে। না হলে সেই আত্মা ভূত হয়ে হাজার বছর পথ হাঁটবে পৃথিবীর পথে।মাঝি কেরন কিন্তু হিসেবে খুব পাকা। সে পাড়ের কড়ি ছাড়া কাউকে নদী পাড় করে না।মৃতদেহ সৎকারের সময় সাথে কিছু সোনাদানা দিলে, সেগুলো কেরনের কাছে পৌঁছে যাবে। সেই সোনাদানার বিনিময়েই পাতালের নদী পার করবে কেরন।

ডিরোস গুহায় নৌকার সামনে দাঁড়িয়ে আমার শুধু গ্রিক পুরানের এই দৃশ্যকল্প মনে ভেসে উঠছিলো।নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার নাম কি কেরন? ইংরেজী বুঝলো কিনা জানি না।ঠাণ্ডা গলায় বললো, সাইলেন্ট।গুহার পাথরে সেই সাইলেন্ট গমগম করে উঠলো।সিনেমার ভিলেনের ডাবিংয়ের মত রিসাউন্ড হতে লাগলো – সাইলেন্ট, সাইলেন্ট, সাই……।
আমার আর সন্দেহ রইলো না, এই সেই গ্রিক পূরানের কেরন।কোন সাধারণ মানুষ অমন শব্দ করতে পারে না।আমার মন বলছিলো, না না, আমি আরো কিছুদিন বাঁচতে চাই।এখুনি কেরনের নৌকায় উঠবো না।কিন্তু সাথে আছে বউ-বাচ্চা, সিনিয়র কলিগ ফারহানা ম্যাডাম আর গ্রিক সহকর্মী এভান।নৌকায় না ওঠলে, এদের কাছে প্রেস্টিজ থাকবে না।তাই ভগবানকে ডাকতে ডাকতে নৌকায় উঠেই পড়লাম।

ভগবানের কথা মনে হতেই আর এক বিপদ মনে এলো।এতোক্ষণ তো গ্রিক পুরাণের কথা মনে হচ্ছিলো।ভয়ের বিপক্ষে একটা যুক্তি ছিলো, আমি তো গ্রিক না।আমি জন্মেছি সুদূর বঙ্গদেশে।আমি তো কেরনের নেটওয়ার্কের বাইরের মানুষ।আমারে কেরন কিছু করতে পারবে না।কিন্তু নৌকায় ওঠার সময় ভগবানের নাম নিতেই মনে পড়লো, আরে – আমাদের সাধকেরাও তো ভবনদী পার হবার কথা বলে গেছেন।বিজয় সরকারের গানে আছে,
‘কোনদিন ছাড়িবে নৌকা, মাঝি, আমারে তাই কইও
পেছনে পড়ে যাই যদি,মাঝি, আমায় সঙ্গে করে লইও’

হায় হায়, এই মাঝিই বুঝি সেই মাঝি। আমার যে আজ কী হবে!
এমন সময় নৌকা চলতে শুরু করলো।মাঝির কড়া হুকুম – চুপচাপ নৌকায় বসে থাকতে হবে, কোনরকম নড়াচড়া করা যাবে না।নড়াচড়া করলে নৌকা উল্টে যাবে, একজনও বাঁচবেন না।মাঝি আবার এখন গাইড।সে গুহার কোথায় কি আছে একটূ একটূ বিবরণ দিচ্ছে। আমার পাশে চার বছরের ছেলে নিয়ন।আর পেছনে তার মা।আমি ছেলেকে ধরে আছি।তার মা আমাকে ধরে আছে।ধরার স্টাইলেই বুঝা যাচ্ছে সবাই ভীষণ ভয় পাচ্ছে।নিয়ন এতোক্ষণ ভয় পায় নি।কিন্তু নৌকা একটু আগাতেই গুহার ভেতর ছোট্ট ছোট্ট গলি। সেগুলো দিয়ে নৌকা যাচ্ছে।মাঝে মাঝে গুহার উচ্চতা অনেক কমে গেছে।মাথা প্রায় লেগে যাচ্ছে পাথরের সাথে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।এবার নিয়ন চুপিচুপি বললো, বাবা, ভয় করছে।

বিষয়টা মারাত্মক। এখন নিয়ন যদি ভয়ে কান্না শূরু করে, চিৎকার করে হাত-পা ছুড়তে শূরু করে,তাহলে নৌকা ডূবে যাবে।এখন আমার নিজের ভয় নয়, ছেলের ভয় ছাড়াতে হবে। না হলে মহাবিপদ।ছেলের মা বললো, ছেলেকে ছড়া বলো।মনোযোগ অন্য দিকে রাখো।ছড়ার কথায় প্রথমেই মনে পড়লো, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।কিন্তু এই ছড়ায় ছেলের ভয় যাবে না, বরং বেড়ে যাবে।ছেলের মা বললো, নিয়ন তো ইংরেজী রাইমস শূরু করছে, একটা নৌকার ছড়া বলো।আমি চি চি গলায় শুরু করলাম –
‘Row, row, row your boat, gently down the stream
Merrily, merrily, merrily, merrily, life is but a dream’

আহা, এমন কষ্টের মধ্যেও আমি গান গাইছি – লাইফ ইজ বাট এ ড্রিম।ছড়ায় কিছুটা কাজ হলো।নিয়নও গাইতে শুরু করেছে- রো রো রো ইউর বোট …… তার মনোযোগ অন্য দিকে চলে গেছে।আমার ভয়ও মনে হয় কমে এসেছে।

নৌকা আগাচ্ছে।আর একটা মোড় ঘুরতেই সামনে এলো তিন মাথার একটা পাথর।দেখতে একেবারে কুকুরের মতো।মাঝি এবার নাটকীয় গলায় বললো, এই তিনমাথার কুকুরটার দিকে তাকান।আমরা তাকালাম।

মনে হয় পুরানের যুগের মানুষদের তিন সংখ্যাটার উপর প্রবল আকর্ষণ ছিলো।তারা অনেক কিছুতেই তিন খুঁজতেন।পৃথিবীর সব পুরাণেই মোটামুটি তিনটা জগতের কথা আছে – স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল।একইভাবে ত্রিভুবন, ত্রিকাল, ত্রিনয়ন এমন সব তিনবাচক জিনিসের ছড়াছড়ি।একইভাবে গ্রিক পুরানের পাতাল দেবতা হেডিসেরও নাকি একটা পোষা কুকুর ছিলো, সেই কুকুরের তিনটা মাথা।সে গুহার মুখে বসে তিনমাথার ছয়টা চোখে পাতালপুরী পাহাড়া দেয়, যাতে কেউ এখান থেকে বের হতে না পারে।

মাথার উপরে পাথরে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের মাঝি বললো, এই হলো হেডিসের সেই কুকুর।নাম কারবেরাস।কুকুরের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো আর রক্ষা নেই।ও আমাদের আর এখান থেকে বের হতে দিবে না।সত্যজিত রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার কথা মনে পড়লো।গুপি আর বাঘা হীরার খনির চাবি চুরি করতে গিয়ে বাঘের সামনে পড়ে গান গাইছিলো, ‘দয়া করো বাঘ মামা, তুমি যে এখানে কে তা জানতো’।কুকুরের মূর্তি দেখে আমারও মনে হলো, তুমি যে এখানে কে তা জানতো।
গুহায় মাত্র এক কিলোমিটারের মত পথ – নৌকা করে এক মুখ থেকে অন্য মুখে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সেই এক কিলোমিটার আর ফুরাচ্ছিলো না।এমন পরিবেশে এক মিনিটকে মনে হয় এক যুগ।সেই এক যুগও অবশেষে শেষ হলো। নৌকা পাড়ে ভিড়লো।প্রাণ নিয়ে বের হলাম পাতালপুরী থেকে।

বের হবার সময় মাঝি হাসি দিয়ে বললো, স্যার, আমার নাম কেরন নয়, আমার নাম কস্তাস।আপনার ছেলের বয়সী আমারও একটা ছেলে আছে।আমি প্রতিদিন সকালে নৌকা চালাতে আসার সময় আমার ছেলেও এই ‘রো রো রো ইউর বোট …’ গানটা করে।আমি প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা এই গুহায় নৌকা চালাই।

সাপ্তাহিক ছুটি নেই না।গুহার ভেতরে অক্সিজেন কম, একটানা অনেকক্ষণ থাকা যায় না।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।যখনই ক্লান্ত হয়ে যাই, কষ্ট লাগে, মনে ভাবি – আমার ছেলে আমার জন্য গাইছে –
‘Row, row, row your boat, gently down the stream
Merrily, merrily, merrily, merrily, life is but a dream’

কস্তাস আবার বললো, হুম, ঠিকই শূনেছেন – লাইফ ইস বাট এ ড্রিম।

© সুজন দেবনাথ