Select Page

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এক ভয়াবহ প্লেগ এসেছিল এথেন্সে।
ঘটনা সক্রেটিসের জীবিত কালের, প্লেটোর জন্মের কয়েক বছর আগে। সেই প্লেগে এথেন্সের তিন ভাগের এক ভাগ লোক মারা গিয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন সেসময়ে ক্ষমতাশীন এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রধান নেতা পেরিক্লিস। কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলেন সক্রেটিস। সারা জীবন কঠিন সাধনা আর শরীরচর্চা করে সক্রেটিসের শরীরের ইমিউনিটি অনেক বেশি ছিলো। এই প্লেগের সময়ই সফোক্লিস লিখেছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ট্রাজেডি নাটক ‘রাজা ইদিপাস’। এই নাটকের প্লটও প্লেগ নিয়ে। সফোক্লিস একেবারে শুরুতেই দেখান প্লেগে মানুষ মারা যাচ্ছে –
‘লাশ আর লাশ, চারিদিকে লাশ
পুস্পবনে লাশ, শস্যক্ষেতে লাশ
প্রতি মায়ের কোল জুড়ে শুধুই লাশ’

নাটকে সেই প্লেগের কারণ খুঁজতে গিয়ে রাজা ইদিপাস জানতে পারেন যে, প্লেগের কারণ হলো ইদিপাস নিজে। তার পাপেই দেবতা তার নগরকে শাস্তি দিচ্ছেন। এখানে সফোক্লিস লিখলেন তার কালজয়ী সংলাপ। মাত্র দুটো বাক্যে তিনি লিখে ফেলেছিলেন গ্রিক ট্রাজেডির মূল দর্শনটি – ‘এতো কষ্ট করে তুমি যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ, সেটি আসলে তুমি নিজেই। তুমি নিজেই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু ’।

সফোক্লিস ‘রাজা ইদিপাস’ লিখেছিলেন, তখনকার নেতা পেরিক্লিসকে টার্গেট করে। সফোক্লিস দুচক্ষে দেখতে পারতেন না পেরিক্লিসকে। তিনি নাটকের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলেন যে – এথেন্সের প্লেগের জন্য দায়ী পেরিক্লিস। ইদিপাস যেমন তার শহরের প্লেগের জন্য দায়ী, তেমনি পেরিক্লিসও এথেন্সের প্লেগের জন্য দায়ী। সফোক্লিস ভাবতেন – পেরিক্লিস একজন ব্যাভিচারী। সে আসপাশিয়া নামে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী নারীকে ভালোবাসে, কিন্তু বিয়ে করতে পারেনি। কারণ সে নারী এথেন্সের নাগরিক না। এথেন্সের আইনে তখন অন্য কোন নগরের কাউকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। পেরিক্লিস বিয়ে করতে পারেনি আসপাশিয়াকে, কিন্তু ঘরে নিয়ে এসেছে, তাদের সন্তানও আছে।

পেরিক্লিসের জীবনের সাথে মিলানোর জন্য তিনি নাটকে ইদিপাসকে বানালেন একজন মারাত্মক ব্যাভিচারী। ইদিপাস না জেনে তার বাবাকে হত্যা করে ফেলে আর বিয়ে করে নিজের মাকে, সেই বিয়েতে তাদের সন্তানও হয়। সেই পাপেই প্লেগ এসেছে। সফোক্লিস নাটকের মাধ্যমে এথেন্সের মানুষকে বুঝাতে চাইলেন, এথেন্সের প্লেগের জন্য দায়ী ব্যাভিচারী পেরিক্লিস। তিনি চেয়েছিলেন, পেরিক্লিস যেন ক্ষমতা থেকে বিদায় হয়, এথেন্সে থেকে নির্বাসন নেয়। সেজন্য তিনি নাটকে দেখালেন, রাজা ইদিপাস অনুতাপে নিজের চোখ নষ্ট করে অন্ধ হয়ে রাজ্য থেকে চলে যাচ্ছে, তার মা আগুনে পুড়ে আত্নহত্যা করছে।
সফোক্লিসের নাটকের ইদিপাসের মতো বাস্তবের পেরিক্লিস রাজ্য ছেড়ে যায় নি। তিনি আসলে পৃথিবী ছেড়েই চলে গিয়েছিলেন। এথেন্সের প্লেগেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্য খুবই করুণ। আমার ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ-এ পেরিক্লিসের মৃ্ত্যুদৃশ্যটি এমনঃ
” পেরিক্লিস বুঝতে পারছেন, তার সময় শেষ। তিনি চোখ বুজে আছেন। গলা দিয়ে স্বর বের হতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্টে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন – ওই যে পার্থেনন, ওই যে এথিনার মূর্তি – দেবী এথিনা হাসছেন। দেবী ঝলমল করছে। এখনো এথেন্স ঝলমল করছে। আমি এমন এথেন্স দেখতে দেখতেই মরতেই চেয়েছিলাম। হঠাৎ তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আসপাশিয়া ভাবছে, চোখ কি খুলবে না? একটু পর অস্ফুটভাবে পেরিক্লিস বললেন, ফিডিয়াস! ঐ যে শিল্পী ফিডিয়াস। ফিডিয়াস ডাকছে, আমাকে ডাকছে। পাতালপুরী থেকে ডাকছে। আসপাশিয়া বুঝল আর বেশি সময় নেই। সে পেরিক্লিসের মাথাটা কোলে নিয়ে বসল। চারপাশে অনেক মানুষ। সবাই কাঁদছে। এথেন্সের এক নম্বর নাগরিক চলে যাচ্ছেন। তার স্বপ্নের এথেন্স ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন। আসপাশিয়ার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি পড়ল পেরিক্লিসের কপালে। পেরিক্লিস আসপাশিয়ার হাতটা চেপে ধরলেন। তার চোখ পার্থেননের দিকে। সে চোখের জ্যোতি স্পষ্ট। হঠাৎ বলে উঠলেন, আসপাশিয়া, হোমারের লেখা সেই লাইনগুলো একবার বলবে? মরণ নিয়ে লেখা কথাগুলো। আসপাশিয়া কাঁদতে কাঁদতে শুরু করল,
‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ
মরণ – বল না রে – কত রকম তোর রূপ
সামনে-পিছনে, ডানে বায়ে-যে দিক পানে চাই
আসছে মরণ, চোরা গলি দিয়ে, বাঁচার উপায় নাই।’

হঠাৎ মনে হলো পেরিক্লিসও তার সাথে বলছেন, ‘সবখানে মরছে মানুষ, লাশগুলো করে আছে চুপ…মরণ – বল না রে – কত রকম তোর রূপ’। পেরিক্লিস চোখ বুজলো। এথেন্সের এক নম্বর নাগরিককে কেড়ে নিল ভয়ংকর প্লেগ।”
তার মৃত্যুর পরেই এথেন্স দুর্বল হয়ে যায়। এথেন্স হেরে যায় স্পার্টার কাছে। এথেন্সের সোনালী দিন শেষ হয়ে যায়। দুর্যোগ চলতে থাকে। মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, হানাহানি শুরু হয়। এর পরিণতিতেই সক্রেটিসের মতো মানুষকেও মিথ্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এথেন্সের সোনালী দিন শেষ হবার জন্য অনেক পণ্ডিতই এই প্লেগকে দায়ী করেন।
……………………
// সুজন দেবনাথ // রেফারেন্সঃ ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’