Select Page

আমারও একটা ভূতের গল্প চাই। আমার সব বন্ধুরই ভূতের গল্প আছে, শুধু আমার নেই। সবাই ভূত দেখে, শুধু আমি দেখি না। ওরা যখন তখন ভূত দেখে। কেউ জ্বীন দেখে, কেউ পরী দেখে। ছেলেরা দেখে পরী আর মেয়েরা দেখে জ্বীন। কিন্তু আমি জ্বীন, পরী কিছুই দেখি না।

তখন ক্লাস সিক্স। মাত্র হাইস্কুলে যাচ্ছি। অনেক নতুন বন্ধু। ওরা চান্স পেলেই খালি ভূতের গল্প বলে। গাউচ্ছা ভূত – গাছে থাকে, মাউচ্ছা ভূত – মাছ ধরতে গেলে পিছে পিছে যায়। সবাই গল্প বলে আর আমি চুপ করে বোকার মতো শুনি। এভাবে বোকা হয়ে থাকতে আমার আর ইচ্ছা করে না। আমারও একটা ভূতের গল্প দরকার। ভূত আমাকে দেখতেই হবে। তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ভূত দেখা চাই।

বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে একটা বড় গাব গাছ। গাব গাছে নাকি পেত্নী থাকে। তো পেত্নীর খোঁজে এক অমাবস্যা রাতে একা একা বের হলাম। সাথে একটা টর্চ। কিন্তু টর্চ জ্বালানো যাবে না। আগুন আর আলো থাকলে, ভূত কাছে আসে না। পেত্নীর আশায় অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকলাম। ঘুম এসে গেলো, পেত্নী এল না।

তাহলে মনে হয় টর্চ নিয়ে গিয়েছি বলে ভূত ভয়ে আসে নি। পরদিন আবার গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে টর্চ ছাড়া। কয়েক ঘণ্টা মশার কামড় খেয়ে ফিরে আসলাম, ভূতের দেখা নেই। এভাবে যখনই সুযোগ পাই ভূত খুঁজি। কিন্তু ভূত কোথাো পাই না। ভূত না পেলেও, ভূত খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়ে গেলাম ভূত বিশারদ। একেবারে বৈজ্ঞানিক বিশারদ। নিজের গবেষণা আর অন্যদের গল্প শূনে আমি ভূত বিষয়ে অনেকগুলো নতুন সূত্র বের করে ফেললাম।

আমি অনেক চেষ্টা করেও অমাবস্যা রাতে ভূত দেখি নি। বরং দু’একবার চাঁদের আলোতে ভয় ভয় লেগেছে। তাহলে ভূত-সূত্র ১ – ভূত অমাবস্যার রাত্রে বের হ্য় না। ভূত বের হয় পূর্ণিমা রাতে। ভূত অন্ধকারে চোখে দেখে না। শুক্লপক্ষের রাত আলো-আঁধারী, তখনই ভূতের সুবিধা।

আবার লক্ষ্য করলাম – অন্ধকারে একা হাঁটলে, ভূত পিছে পিছে হাঁটে। একেবারে পায়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে শব্দ করে। আমি থেমে গেলে শব্দও থেমে যায়। এথেকে ভূত-সূত্র ২ – ভূতের নিজস্ব কোন শব্দ নেই, আপনার শব্দ থেকেই সে শব্দ পায়।

এই রকম ভূত বিশারদ হয়েও আমি কারও কাছে ভূতের গল্প বলতে পারি না। কারণ আমি শুধু থিউরি জানি, এখনো প্রাকটিক্যালি ভূত দেখতে পারি নি। সেই দুঃখ মনেই আছে।

এর মধ্যে রোজার ছুটিতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছি। সেখানের বাজারে ম্যাজিক হচ্ছে। আমি আর ফুফাতো ভাই দীপক এক সন্ধ্যায় ম্যাজিক দেখছিলাম। জাদু শেষ হতে কখন যে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গেছে সেটা আমরা খেয়ালই করি নি। ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি।

মন্দিরের মোড় পার হলে বাজারের আলো আর দেখা যায় না। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পা টিপে টিপে দুজনে আগাচ্ছি। হঠাৎ দেখি সেই অন্ধকারে কি যেন একটা এগিয়ে আসছে। কী আসছে বুঝা যাচ্ছে না। শুধু দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। এমন উজ্জ্বল চোখ আমরা জীবনে দেখি নি। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। একেবারে নিঃশব্দে আসছে।

কখন যেন আমাদের দুজনেরই হাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে। শক্ত করে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়েছি।

ধীরে ধীরে ওই জ্বলজ্বলে চোখদুটো আগাচ্ছে। একেবারে হরর মুভির দৃশ্য। ভয়ংকর চোখ, এখন আরো সামনে এসে গেছে। এই বুঝি আমাদের ধরে ফেললো।

আমি ভাবছি, আমি কি সত্যিই ভূত দেখছি? আমার কি দৌড়ে পালানো দরকার? না, দৌড় দিতে পারব না। আমার পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে।

এখন ভূতটা আমাদের একেবারে সামনে এসে গেছে। ও দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওর চোখদুটো স্থির, ভয়ংকর রকম স্থির। একটুও নড়াচড়া করছে না। আমি ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একটু আগে চোখ খুলে অন্ধকারে ওই ভয়ংকর চোখ দুটো ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখন চোখ বন্ধ করায় অনেক কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি – ভূতের ওই চোখের পেছনে বড় একটা মাথার খুলি, একটু একটু নড়ছে। সামনে লম্বা লম্বা হাত, হাতে শুধুই হাড়, হাড়গুলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটা অদ্ভুত হাসিও শুনতে পাচ্ছি।

না, আমি চোখ খুলব না। আমার চোখ খোলার জন্যই ভূতটা অপেক্ষা করছে। চোখ খুললেই হামলে পড়বে আমার উপর।

কতক্ষণ এভাবে কাটছে জানি না। মনে হচ্ছে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ ভূতটা তীব্রভাবে চিৎকার করে উঠলো – ঘেউ ঘেউ – ঘেউ…উ।
আমরা দুজনেই মাটিতে পড়ে গেলাম। ব্যথা পেয়ে হুঁশ ফিরে এলো। তাকিয়ে দেখি ভূতটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। তার চোখ আর দেখা যাচ্ছে না।
দীপক বললো, ছিঃ ছিঃ। বেকুব, শেষ পর্যন্ত একটা কুকুর দেইখ্যা ডরাইলি!!

এটা একটা কুকুর? না, না, সে কি করে হয়? আমি তো অনেক সাহসী। কুকুর দেখে ভয় পেয়েছি? না, তা হতে পারে না। বললাম, চল, একটু এগিয়ে দেখি।

মোড় পার হয়ে কুকুরটা বাজারের দিকে যাচ্ছে। ওখানে আলো আছে। বেশ বড়োসড়ো একটা মিশমিশে কালো কুকুর, নিতান্ত ভদ্রভাবে হেঁটে যাচ্ছে। দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম। একজন বোকা হলে মানা যায়, কিন্তু একসাথে দুইজন?

দীপক বললো, ভাই, ভালো করে কুকুরটার লেজটা দেখ দেখি। লেজটা কেমন যেন সোজা সোজা লাগছে। কুকুরের লেজ কোনদিন সোজা হয়?
আমি চোখ ঘষে তাকালাম। কুকুরটা বেশ দূরে চলে গেছে। লেজটা কি সোজা? কি জানি, দীপক যখন বলছে, তখন সোজাই।

আমি বললাম, কুকুরটার সাইজ দেখছিস? এত্তবড় কুকুর এই গ্রামে আসবে কোথা থেকে? আর এত্তোজোরে কোন দেশী কুকুরে ডাকতে পারে? কী ভয়টা পেয়েছিলাম। এটা কুকুর হতেই পারে না। এটা অন্য কিছু।

একটু ভেবে দীপক বললো, আচ্ছা, ভূতের পা তো উল্টা হয়। ভাল করে পা দেখ তো।

ভূত-কুকুর ততোক্ষণে অনেক দূরে। পা দেখা সম্ভব না। কিন্তু আমার মন সেটা দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে – কুকুরটার চারটা পা উল্টা। উল্টা পা নিয়েই সে সামনের দিকে হাঁটছে। বললাম, হুম, পা তো মনে হয় উল্টোই।

দীপক বললো, চল, আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। দৌড় দিয়ে বাসায় চলে যাই।

বাসায় এসে বীরের মতো বললাম, জানো, আজকে কি হয়েছে! আমাদের তো একটা কুকুর-ভূতে ধরছিলো। কোনমতে জান নিয়ে দৌড়ে এসেছি।
শুনে দিদিমা বললো, ওই মোড়টা খুব খারাপ। মোড়ের পুস্পরিনীতে গেল বছর একটা মেয়ে ডুবে মারা গেছে। মেয়েটার নাম আছিয়া। আসল কথা ওর বাবা-মা কাউকে বলে নাই। আসলে প্রেম-ভালোবাসার ঘটনা। কচি মেয়েটা পুকুরে ডুবে মরছে। অপঘাতে মৃত্যু। সেই থেকে ওই মোড়টা খারাপ। শনিবারে, মঙ্গলবারে অনেকেই ঐখানে ভয় পায়।

আমি আর দীপক চোখে-চোখে তাকালাম। বুঝেছ? তাহলে এই ঘটনা। ওটা কুকুর-ভূত না, ওইটা হলো আছিয়া-ভূত।

এভাবে আমি একটা ভূতের গল্প পেয়ে গেলাম। এখন আমারও একটা ভূতের গল্প আছে। এই ভূত আমি নিজেই দেখেছি।

ছুটি শেষে বাড়ি ফিরে আসলাম। সেদিন সন্ধ্যাই সবাইকে ডেকে বলছি, আরে শোন, শোন, আমি তো একটা ভূত দেখলাম –
গ্রামের নাম মধ্যপাড়া, বাজারের নাম মনোহর বাজার। বাজারের পরে মন্দিরের মোড়টা ঘুরলেই সাজিকান্দি। ছুটিতে সাজিকান্দি বেড়াতে গেছি। সেদিন ভাদ্র মাসের অমাবস্যা। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে কোন তারা নেই। হঠাৎ দেখি একটা কুকুর। ইয়া বড়ো কুকুর। কুকুরটার লেজ সোজা। পা গুলো উল্টা। উল্টা পা নিয়েই কুকুরটা আমার সাথে হাঁটছে। আমি যেখানে যাচ্ছি, কুকুরটাও যাচ্ছে। হঠাৎ কুকুরটা কথা বলে ওঠলো। আশ্চর্য, একেবারে মানুষের গলা! না না, ছেলে মানুষের গলা না। মেয়ে মানুষের গলা। চিকন স্বরে কুকুরটা বললো, একটু জল দিবা?

আমি চমকে উঠলাম, ভয়ে ভয়ে বললাম, কে? কে তুমি?
সে বললো, আমি আছিয়া।
আমি বললাম, কি হয়েছে তোমার?
সে বললো, আমার বড়ো পিপাশা। আমি ঐ জলে ডুবে মরে গেছি। মরার সময় অনেক জল খাইছি। কিন্তু তৃষ্ণা মিটে নাই। একটু জল দিবা?
কথা শেষ হতেই তাকিয়ে দেখি – সেখানে কোন কুকুর নেই, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই আমি চোখ বন্ধ করে দৌড়।
এখনো সেই মধ্যপাড়ার সাজিকান্দিতে অন্ধকার রাতে মাঝে মাঝেই শুনা যায় – আমারে একটু জল দিবা!
// …………………
© সুজন দেবনাথ