Select Page

২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। অলিম্পিক গেমস হচ্ছে সিডনী শহরে। টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে। খেলা চলছে, আবার চান্স পেলেই দুষ্টু ক্যামেরাম্যান সিডনী শহরটাও দেখিয়ে দিচ্ছে ফাঁকতালে। সুন্দর সুন্দর জিনিস টিভি পর্দায়। এর মধ্যে একটু পর পর ভেসে উঠছে একেবারেই ভিন্ন রকমের একটা ভবন। ধরনে গড়নে একেবারেই আলাদা এই বিল্ডিং। সুন্দরের একটা একেবারেই নতুন প্রকাশ।

আমার কাছে তখনও সুন্দর ভবন মানে ইউরোপীয়, ভারতীয় বা চীনা স্টাইলের স্থাপনা। দেয়ালে থাকবে চোখ ধাঁধানো কারুকার্য। সামনে পেছনে সুন্দর সুন্দর (নারী) মূর্তি। এসব কিছুই ওই বিল্ডিংয়ে নেই। তবু কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছে। নীল সাগরের বুক থেকে কতগুলি কোণাকৃতি সাদা ফালি উঠে গেছে অনেক উঁচুতে। উঠতে উঠতে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে নান্দনিকতার অন্য সমীকরণ। কেমন একটা ভিন্ন স্বাদের জ্যামিতিক নকশা। দাঁড়িয়ে আছে সৌন্দর্য্যের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে। আমি হা করে টিভিপর্দায় গিলছিলাম সেই ভবনের মাধুর্য। সেদিন যে ভবনটার ছবি আমাকে সৌন্দর্য্যের নতুন সংজ্ঞা শিখিয়েছিল, সেটি সিডনী অপেরা হাউজ। এটি আসলে বিশ শতকের স্থাপত্যশিল্পের একটি আইকন। Expressionist Architecture এর পথিকৃত এই ভবন।

জগতের প্রতিটা ভালো জিনিসের সাথেই মিশে থাকে কোন না কোন দীর্ঘশ্বাস। এক এক জন সুন্দরী ললনা যেমন অনেক পুরুষের দীর্ঘশ্বাস। তেমনি এই অপেরা হাউজের সাথেও মিশে আছে দীর্ঘশ্বাস। সে দীর্ঘশ্বাস এর নির্মাতার। এর স্থপতির। তাঁর নাম জন উৎজোন। জাতিতে ডেনিশ। এই অমর শিল্পী ডিজাইন করেছেন সিডনি অপেরা হাউজ। কিন্তু কাজ শেষ হবার আগেই অজিরা তাঁকে বের করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। অপেরা হাউজ উদবোধনের পর ৩৫ বছর বেঁচে থাকলেও, উৎজোন কোনদিন দেখতে পারেননি তাঁর অমর সৃষ্টিকে।

অপেরা হাউজের ডিজাইনের জন্য সিডনী সরকার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। ৩২ দেশের ২৩৩ জন স্থপতিকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হলো উৎজোনের ডিজাইন। সম্মানের সাথে সিডনিবাসী তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন সেখানে। তিনি কাজ শুরু করলেন কন্ট্রাকটরদের সাথে। এই ডিজাইনটি ছিল আর্কিটেকচারের জগতে একেবাব্রেই নতুন ধারার। আগে কোনদিন এমন জ্যামিতিক নকশায় খাড়া সিমেন্ট শিটের কোন ভবন তৈরি হয়নি। তাই এমন ভবন তৈরির ব্যয় নিয়ে তেমন কোন ধারনাই ছিল না। দেখা গেল, ব্যয় যা ধরা হয়েছিল, শুরু করতেতেই তাঁর চেয়ে বেশি খরচ হয়ে গেছে। এই ব্যয় নিয়ে শুরু হল রাজনীতি। লোকজন বলাবলি করতে লাগল যে, এই অপেরা হাউজের নামে তাঁদের ট্যাক্সের টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। বিরোধী লেবার পার্টি এই টাকার শ্রাদ্ধ নিয়ে বাজার গরম করে ফেলল। সেই গরমের ছোঁয়ায় পরে গেল সিডনির সরকার। নির্বাচনে জিতে গেল বিরোধী লেবার পার্টি। আর সরকারী স্থাপনা বিভাগের মন্ত্রী হলেন ডেভিস হিউজ। হিউজ মন্ত্রী হয়েই, রাতে পার্টি দিলেন। আর সেই পার্টিতে হিউজের মেয়ে একটা গোপন ঘোষণা করল – তাঁর বাবা সিডনির জন্য একটা হিউজ কাজ করবেন। ‘My father will fire Utzon’ তিনি অপেরা হাউজের স্থপতি উৎজোনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন। জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ হতে দিবেন না।

শুরু হল মন্ত্রী হিউজ আর আর্কিটেক্ট উৎজোনের রশি টানাটানি। কিন্তু হিউজ হলেন মালিক আর উৎজোন হলেন কর্মচারী। তো এই টানাটানির ফলাফল যা হবার কথা। উৎজোনকে ফায়ার করা হল। চোখের জলে ভিজতে ভিজতে দেশে ফিরে গেলেন তিনি। দৃশ্য থেকে উৎজোনের বিদায়। কিন্তু মন্ত্রী অপেরা হাউজের কাজ বন্ধ করতে পারলেন না। প্রথম অনুমানের পাঁচগুণ টাকা খরচ করে একদিন ঠিকই সাগরের বুকে জেগে উঠল অপেরা হাউজ। অজিরা তাকিয়ে দেখল – এর চেয়ে সুন্দর কিছু তাঁদের জাতীয় অর্জনে নেই। তাঁরা টাকার কথা ভুলে গেল। অহংকারে বুক ফুলে উঠল তাঁদের। বিশ্ববাসীকে দেখাতে বিশাল সমারোহ করে উদবোধনের আয়োজন করা হল। ব্রিটেন থেকে রাণী এলিজাবেথ গেলেন উদবোধন করতে। লাস ভেগাসের সেরা নট-নটি আসলো থিয়েটার করতে।

কিন্তু কোথায় সেই স্থপতি? সেই অভিমানী রাজকুমার? অজিরা কি একেবারেই ভুলে গেছে তাঁকে? না তাঁকে ভোলেনি। তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছে। উদবোধনের দিনে তাঁকে সম্মানের সাথে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সিডনীর মূখ্যমন্ত্রী লিখেছেন অনুতাপের চিঠি। কিন্তু না। তিনি যে অভিমানী রাজকুমার। তিনি আসবেন না। শুধু সেই উদবোধনী অনুষ্ঠানেই নয়, আর কোনদিনই তিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা দিবেন না। অপেরা হাউজ উদবোধনের পরে ৩৫ বছর বেঁচে ছিলেন উৎজোন। কিন্তু আর আসেননি সিডনীতে। দেখেননি তাঁর নিজের নির্মান করা সিডনী অপেরা হাউজকে।

সেখানে তাঁর পেন্সিলের স্কেচ অপ্সরা হয়ে লাখো মানুষের চোখকে তৃপ্ত করছে। অথচ তাঁর চোখ কোনদিন দেখতে পায়নি সে অপ্সরাকে। প্রশান্ত সাগরের পারে তাঁর স্বপ্নের রাজকন্যাকে ছুঁয়ে দেখছে সৌন্দর্য্য পিয়াসী মিলিয়ন হাত। অথচ তাঁর নিজের হাত কোনদিন ছুঁয়ে দেখেনি সেই রাজকন্যাকে।

© সুজন দেবনাথ