Select Page

ইউরোপে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান বাহিনীর জয়-জয়াকার। হিটলার যেখানে হাত দেন সেখানেই বিজয়। তাঁর জেনারেলদের ফিল্ডমার্শাল উপাধি দিতে দিতে তিনি অস্থির। যুদ্ধে জয়লাভ করলে সেনাপতিকে ফিল্ডমার্শাল উপাধি দেয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতের সেনাপতি জেনারেল মানেকশ পেয়েছিলেন ফিল্ডমার্শাল। সেটা এই লেখার বিষয় না। বিষয় হল – হিটলার। তিনি তখন যে জেনারেলকে যেখানে পাঠাচ্ছেন, সেই জিতে যাচ্ছে আর ফিরে এসে বলছেন, আমাকে ফিল্ডমার্শাল দাও। যেন হিটলার ফিল্ডমার্শাল উপাধি নিয়ে বসে গেছেন, আর জেনারেলদের বলছেন, ‘চোখ বন্ধ, বেছে নাও’। হিটলারের জন্য এমনই সুখের শুরু ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর সকল রণকৌশল কাজে লেগে যাচ্ছিল। আর জার্মানির হুংকারে কাঁপছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচ, বেলজিক, পোলিশসহ সমগ্র ইউরোপ।

কিন্তু কিছুদিন পরে থেকেই সেই বিজয় একটু একটু করে থেমে যেতে থাকে। হিটলার লক্ষ্য করলেন, তাঁর যুদ্ধকৌশল কেন যেন কাজ করছে না। যেখানে নিশ্চিত জয়লাভ করার কথা, সেখানেও আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না। তাঁর অত আদরের ফিল্ডমার্শালরা হয় হেরে যাচ্ছে, না হয় আক্রমনে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্রিটিশদের আশানুরূপ ক্ষতি করতে পারছে না। হিটলার এবার ফিল্ডমার্শালদের ধমক লাগালেন – ‘কৌশল কাজ করছে না কেন, অ্যাঁ? ফিল্ডমার্শাল হইয়া কি গায়ে তেল হইয়া গেছে? আগের মত আর নড়তে মন চায় না?’ ফিল্ড মার্শালরা মাথা নিচু করে থাকে। উত্তর খুঁজে পায় না। তাঁরাও জানে না – সমস্যা কোথায়। হিটলার রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে থাকেন।

অবশেষে ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে হিটলারের প্রধান সেনাপতি ফিল্ডমার্শাল রোমেল বের করলেন কারণ। যুদ্ধের সময় জেনারেলদের কাছে ও বিদেশে দূতাবাসে বিভিন্ন বার্তা গোপন সংকেতের মাধ্যমে পাঠানো হয়। যাতে শত্রুরা সেটা পেলেও অর্থ বের করতে না পারে। এক্ষেত্রে জার্মানি যুদ্ধের কৌশলের যেসব বার্তা পাঠায় সেটার অর্থ বের করার কৌশল ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জেনে ফেলেছে। আর তাই জার্মান যুদ্ধকৌশল ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে জার্মানি। এটা বুঝতে পেরে ফিল্ডমার্শাল রোমেল তড়িঘড়ি করে ১৯৪৩ সালের শেষদিকে জার্মানির গোপন কোড পরিবর্তন করলেন। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। জার্মানির শক্তি অনেক কমে গেছে। তাঁদের পরাজয় শুরু হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কি হল আমরা সবাই তা জানি – হিটলার হেরে গেলেন। হেরে গেলেন অনেক কারণে। তবে তাঁর পরাজয়ের সূচনা করেছিল কিছু অফিসার – তাঁরা জার্মানির গোপন কোড বের করে যুদ্ধকৌশল জানিয়ে দিচ্ছিল ব্রিটিশদের।

এই অফিসাররাই হচ্ছেন সাইফার অফিসার। তাঁরা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে গোপন কোড দিয়ে বিদেশে তাঁদের দূতাবাসে পাঠায়। আবার দূতাবাসে ঐ তথ্যের অর্থ বের করে অন্য অফিসারদেরকে জানায়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় এরা মধ্যমনি হয়ে থাকেন।

এবার জার্মানির কাহিনীটা শেষ করি – টেকনিক্যাল বিষয়ে জার্মান জাতির একটা সহজাত প্রতিভার কথা আমরা শুনি। কথাটা অবশ্যই একেবারে রটনা নয়, ঘটনাও বটে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরেই এক জার্মান গণিতবিদ একটি চমৎকার মেশিন তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তথ্য গোপন করার কাজটি ঐ যুগের হিসেবে সবচেয়ে ভালভাবে করা যেত। মেশিনটি হিটলার পছন্দ করলেন। এর মাধ্যমেই তাঁরা যুদ্ধের কৌশল, খোঁজ-খবর পাঠাত। ইংরেজিতে এটিকে বলে জার্মান এনিগমা মেশিন (German Enigma Machine)।

আবার হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবের কথা পোল্যান্ডের জনগণ ভালই জানত। যুদ্ধ শুরুর আগেই কয়েকজন পোলিশ সাইফার অফিসার জার্মান যোগাযোগের গোপনসূত্র ভাঙ্গার কাজে অনেকদূর এগিয়ে যান। আর ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন হিটলার পোল্যাণ্ড আক্রমন করে ২য় যুদ্ধের শঙ্খ বাজিয়ে দিল, তখন ওই পোলিশ সাইফার অফিসাররা ব্রিটিশদেরকে সেটা জানিয়ে দেয়। সেই তথ্য কাজে লাগিয়ে কিংবদন্তী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এলান ম্যাথিসন টিউরিং ঐ German Enigma Machine এর কোড বের করার যন্ত্র তৈরি করে ফেলেন। আর ওই যন্ত্র ব্যবহার করে ব্রিটিশরা জার্মান কৌশল বুঝে বুঝে জার্মানিকে হারানোর ব্যবস্থা করে।

© সুজন দেবনাথ

ইউরোপে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান বাহিনীর জয়-জয়াকার। হিটলার যেখানে হাত দেন সেখানেই বিজয়। তাঁর জেনারেলদের ফিল্ডমার্শাল উপাধি দিতে দিতে তিনি অস্থির। যুদ্ধে জয়লাভ করলে সেনাপতিকে ফিল্ডমার্শাল উপাধি দেয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতের সেনাপতি জেনারেল মানেকশ পেয়েছিলেন ফিল্ডমার্শাল। সেটা এই লেখার বিষয় না। বিষয় হল – হিটলার। তিনি তখন যে জেনারেলকে যেখানে পাঠাচ্ছেন, সেই জিতে যাচ্ছে আর ফিরে এসে বলছেন, আমাকে ফিল্ডমার্শাল দাও। যেন হিটলার ফিল্ডমার্শাল উপাধি নিয়ে বসে গেছেন, আর জেনারেলদের বলছেন, ‘চোখ বন্ধ, বেছে নাও’। হিটলারের জন্য এমনই সুখের শুরু ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর সকল রণকৌশল কাজে লেগে যাচ্ছিল। আর জার্মানির হুংকারে কাঁপছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচ, বেলজিক, পোলিশসহ সমগ্র ইউরোপ।

কিন্তু কিছুদিন পরে থেকেই সেই বিজয় একটু একটু করে থেমে যেতে থাকে। হিটলার লক্ষ্য করলেন, তাঁর যুদ্ধকৌশল কেন যেন কাজ করছে না। যেখানে নিশ্চিত জয়লাভ করার কথা, সেখানেও আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না। তাঁর অত আদরের ফিল্ডমার্শালরা হয় হেরে যাচ্ছে, না হয় আক্রমনে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্রিটিশদের আশানুরূপ ক্ষতি করতে পারছে না। হিটলার এবার ফিল্ডমার্শালদের ধমক লাগালেন – ‘কৌশল কাজ করছে না কেন, অ্যাঁ? ফিল্ডমার্শাল হইয়া কি গায়ে তেল হইয়া গেছে? আগের মত আর নড়তে মন চায় না?’ ফিল্ড মার্শালরা মাথা নিচু করে থাকে। উত্তর খুঁজে পায় না। তাঁরাও জানে না – সমস্যা কোথায়। হিটলার রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে থাকেন।

অবশেষে ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে হিটলারের প্রধান সেনাপতি ফিল্ডমার্শাল রোমেল বের করলেন কারণ। যুদ্ধের সময় জেনারেলদের কাছে ও বিদেশে দূতাবাসে বিভিন্ন বার্তা গোপন সংকেতের মাধ্যমে পাঠানো হয়। যাতে শত্রুরা সেটা পেলেও অর্থ বের করতে না পারে। এক্ষেত্রে জার্মানি যুদ্ধের কৌশলের যেসব বার্তা পাঠায় সেটার অর্থ বের করার কৌশল ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জেনে ফেলেছে। আর তাই জার্মান যুদ্ধকৌশল ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে জার্মানি। এটা বুঝতে পেরে ফিল্ডমার্শাল রোমেল তড়িঘড়ি করে ১৯৪৩ সালের শেষদিকে জার্মানির গোপন কোড পরিবর্তন করলেন। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। জার্মানির শক্তি অনেক কমে গেছে। তাঁদের পরাজয় শুরু হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কি হল আমরা সবাই তা জানি – হিটলার হেরে গেলেন। হেরে গেলেন অনেক কারণে। তবে তাঁর পরাজয়ের সূচনা করেছিল কিছু অফিসার – তাঁরা জার্মানির গোপন কোড বের করে যুদ্ধকৌশল জানিয়ে দিচ্ছিল ব্রিটিশদের।

এই অফিসাররাই হচ্ছেন সাইফার অফিসার। তাঁরা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে গোপন কোড দিয়ে বিদেশে তাঁদের দূতাবাসে পাঠায়। আবার দূতাবাসে ঐ তথ্যের অর্থ বের করে অন্য অফিসারদেরকে জানায়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় এরা মধ্যমনি হয়ে থাকেন।

এবার জার্মানির কাহিনীটা শেষ করি – টেকনিক্যাল বিষয়ে জার্মান জাতির একটা সহজাত প্রতিভার কথা আমরা শুনি। কথাটা অবশ্যই একেবারে রটনা নয়, ঘটনাও বটে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরেই এক জার্মান গণিতবিদ একটি চমৎকার মেশিন তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তথ্য গোপন করার কাজটি ঐ যুগের হিসেবে সবচেয়ে ভালভাবে করা যেত। মেশিনটি হিটলার পছন্দ করলেন। এর মাধ্যমেই তাঁরা যুদ্ধের কৌশল, খোঁজ-খবর পাঠাত। ইংরেজিতে এটিকে বলে জার্মান এনিগমা মেশিন (German Enigma Machine)।

আবার হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবের কথা পোল্যান্ডের জনগণ ভালই জানত। যুদ্ধ শুরুর আগেই কয়েকজন পোলিশ সাইফার অফিসার জার্মান যোগাযোগের গোপনসূত্র ভাঙ্গার কাজে অনেকদূর এগিয়ে যান। আর ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন হিটলার পোল্যাণ্ড আক্রমন করে ২য় যুদ্ধের শঙ্খ বাজিয়ে দিল, তখন ওই পোলিশ সাইফার অফিসাররা ব্রিটিশদেরকে সেটা জানিয়ে দেয়। সেই তথ্য কাজে লাগিয়ে কিংবদন্তী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এলান ম্যাথিসন টিউরিং ঐ German Enigma Machine এর কোড বের করার যন্ত্র তৈরি করে ফেলেন। আর ওই যন্ত্র ব্যবহার করে ব্রিটিশরা জার্মান কৌশল বুঝে বুঝে জার্মানিকে হারানোর ব্যবস্থা করে।

© সুজন দেবনাথ