কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধ ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যে। কিন্তু দুই পক্ষের যোদ্ধারা ছিল পরস্পরের আত্মীয়। তো যুদ্ধ শুরুর সময় অর্জুন যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। তিনি ন্যায়ের পক্ষ পাণ্ডবদের প্রধান বীর। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যুদ্ধ-রথের সারথি মানে রথচালক। বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর দাদু, অস্ত্রগুরু, বংশগত ভাই আর বন্ধুরা। অর্জুনের দেখলেন, যুদ্ধে এইসব আপন মানুষদের হত্যা করতে হবে। যে দাদু তাঁকে ছোট বেলায় আদর করে বড় করেছেন, তাঁকে হত্যা করতে হবে। যে গুরু তাঁর সকল বীরত্বের উৎস, তাঁকে হত্যা করতে হবে। কাছের আত্মীয়-বন্ধুদের খুন করে যুদ্ধ জিততে হবে। এই সত্য যখন একেবারে সামনে, তখন অর্জুনের মনে হলো – কী হবে এই যুদ্ধ জিতে! যাদের নিয়ে রাজ্য ভোগ করার কথা, তাঁদেরকে হত্যা করার যুদ্ধ তিনি করবেন না। পরিবারের মানুষের উপর অস্ত্র চালাতে তিনি পারবেন না। তিনি অস্ত্র ফেলে দিলেন। যুদ্ধ করবেন না।
তাঁর এই মনোভাব দূর করার জন্য তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের দর্শন অর্জুনকে বললেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, অর্জুনের মনের দ্বিধা দূর করে, তাঁকে কর্তব্য পালন করতে উদবুদ্ধ করা। কৃষ্ণ আর অর্জুনের এই এসময়ের কথাগুলোই হলো দার্শনিক গ্রন্থ – গীতা। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন। তাঁর একটা অংশ (অনেকে বলেন সারাংশ) এমন –
.
‘Only time and soul are eternal. All other things in the world are transient. শুধু আত্মা আর সময় (মহাকাল) এই দুটোই চিরকালের। বাকি সব ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর সবকিছুই অস্থায়ী। আজ তোমার যা আছে, আগে সেটা অন্য কারো ছিলো, আর ভবিষ্যতে আবার অন্য কারো হবে। তাই অর্জুন, তুমি তোমার কর্তব্য করো। এই আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু কেউ তোমার নয়। সবই পরমাত্মা মানে ঈশ্বরের অংশ। তুমি নিজেও পরমাত্মার অংশমাত্র। তাই তোমার উদ্দেশ্য হচ্ছে – কর্ম করে যাওয়া, কর্তব্য করে যাওয়া। এই মুহূর্তে তোমার কর্তব্য হলো যুদ্ধ করা। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করা। তো সেটাই করো। গীতার এই দর্শনের নাম ‘কর্ম’ (আমেরিকান পণ্ডিতরা এটিকেই বলে Karma)। অর্জুনের প্রশ্ন ছিলো, তাহলে কর্মই কি মানুষের একমাত্র পথ। উত্তরে কৃষ্ণ বললেন, কর্ম ছাড়া আরও দুটো পথ আছে, একটি জ্ঞানের দর্শন আর অন্যটি ভক্তির দর্শন। তুমি জ্ঞানের পথেও জীবন কাটাতে পারো, আবার ভক্তির পথেও সম্ভব। তবে তিনটি পথের মধ্যে কর্মই এই যুগে সবচেয়ে ভালো পথ। তিনটি দর্শনেই মূল কথা একটিই – Only time and soul are eternal’ গীতায় এই তিনটি দর্শনের বিশদ বিবরণ আছে।
© সুজন দেবনাথ